– প্লিজ মা আমাকে ছেড়ে দে,আমি তো তোর বাবা! আমার সাথে এমনটা করিস না।
– বাবা হয়ে মেয়ের ক্ষিদে মেটাতে পারো না কেমন বাবা তুমি?
– তুই যদি এখন অন্য সাধারণ মানুষের মতো খেতে পারতি……..
কথা শেষ হওয়ার আগেই নিশি তার প্রিয় চারটি লাইন কবিতার ভঙ্গিমায় বলতে শুরু করে,
“আমি পিপাসিত,
শিহরিত গুঞ্জন,
আমার প্রিয় রক্ত,
আর প্রিয়জন”।
আর সাথে সাথে ঝাপিয়ে পড়ে সাদ সাহেবের উপর।
…………………..
আজ সাদ সাহেব এবং তার স্ত্রী নিশাত বেশ চিন্তিত।
কারণ আজ তাদের ভালোবাসার মধ্যে প্রাণ আসতে চলেছে। অর্থাৎ তারা বাবা মা হতে চলেছেন।
অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছেন সাদ সাহেব।
ডক্টর জানান নিশাত এবং বাচ্চার কন্ডিশন খুবই খারাপ। অনেক জটিলতা নিয়েই অপারেশনটি সম্পন্ন হলো।
তোয়ালে মুড়ানো একটি বাচ্চা সাদ সাহেবের কোলে দিয়ে একজন নার্স বললেন, “স্যার মেয়ে হয়েছে”।
কিন্তু সাদ সাহেবের এ খুশি যেনো ক্ষণিকের স্থায়ী।
ডক্টর সাহেব এসে সাদের হাতে হাত রেখে নিশাতের গলায় থাকা খ্রিস্ট লকেটটি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন। নিশাতের অকালে চলে যাওয়াটা সাদ সাহেবের জন্যে ছিলো বেশ যন্ত্রণাদায়ক। তাদের এই সুখ দুঃখের ভাগিদার হতে সেখানে কেউ ছিলো না।
শুধু বাড়ির জিনিসপত্র ঘুছানো আর পরিষ্কার করার জন্যে একটি আয়া ছিলো। মোটা অংকের টাকা সেলারি হিসেবে পাওয়াতে সে শুধু সাদ সাহেবদের বাসায় কাজ করতো।
………….
সাদ সাহেব আর নিশাত পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন। সাদ সাহেবের বাবার বেশ টাকা পয়সা থাকলেও নিশাত ছিলো খুব গরিব ঘরের মেয়ে।
কিন্তু দুই পরিবারের অমত অন্যখানে,
সাদ সাহেব মুসলিম আর নিশাত খ্রিস্টান।
কিন্তু গরিব ঘরের রাজকুমারী যাকে বলে,ঠিক তার থেকেও অধিক সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলো নিশাত।
সাদ সাহেবের জ্ঞান এবং দক্ষতার কারণে তাদের খুব বেশিদিন কষ্টে থাকতে হয় নি। খুব শীগ্রই সাদ সাহেবের পরিশ্রমে একটি দো তলা বিশিষ্ট বাড়ি কিনে ফেলেন।
নিশাত নিরিবিলি খুব পছন্দ করতো, যার কারণে সাদ সাহেব লোকালয় থেকে একটু দূরে এ বাড়িটি কিনেন।
বাড়ির সামনে খোলা বাগান, এক পাশে দু’টি দোলনা একটি বড় আরেকটি ছোট। ছোটটি ছিলো নিশির জন্যে। তারা মনে মনে ধরেই নিয়েছিলেন তাদের আগে একটি মেয়ে হবে, আর নাম দিবে নিশি।
……………..
সাদ সাহেব এখনো নিশির চেহারা দেখেন নি। মনে হলো এক অভিশাপ তার কোলে শুয়ে আছে।
নিশির নড়াচড়া বন্ধ দেখে মুখ থেকে তোয়ালে সরিয়ে নিতেই সাদ সাহেব কেঁপে উঠেন। সাথে সাথে দাঁড়িয়ে নিজের বুক থেকে একটু দূরে সরিয়ে নেন।
অঝোর ধারায় ঘামছেন সাদ সাহেব।
তিনি ভেবেছিলেন ফুটফুটে একটি বাচ্চা হবে নিশাতের। কিন্তু নিশিকে দেখে মনে হয়েছে তার গায়ে যেনো কেউ কালো কালি লেপে দিয়েছে। খুব বিশ্রী দেখতে হয়েছে নিশি।
সাদা তোয়ালের মাঝে এ যেনো এক কালো বাদুড়।
সাদ সাহেব আয়াকে ফোন দিয়ে হসপিটালে ডেকে নেয়। এবং নিশিকে তার কোলে দিয়ে জানান, “নিশাত এই অভাগা মেয়েটিকে জন্ম দিতে গিয়ে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে”।
আয়া-ও নিশিকে দেখে খুব হতাশ হয় এবং বেশ দুঃখ পায়।
আয়া জানতো সাদ সাহেবরা পালিয়ে আসার পর তাদের পরিবারের সাথে কোন যোগাযোগই রাখেন নি তারা। আর এ-ও জানে তিনি কাউকে এ কথা জানাবেন না কারণ সাদ সাহেব ছিলেন খুব জেদি একজন মানুষ।
আয়া তার নিজের পরিবারকে ডেকে নিয়ে আসে। যাতে নিশাতের কবরের ব্যবস্থা করা হয়।
…………….
-আব্বু আব্বু মানুষের রগের নুডলস খেতে কেমন হয়?
নিশির কথাতে ঘোর কাটে সাদ সাহেবের।
৫ বছরের বাচ্চার মুখে এমন কথা শুনে একটুও বিব্রত হন নি তিনি।
কারণ নিশি যখন থেকেই কথা বলতে শিখেছে তখন থেকেই এমন প্যারানরমাল কথা বার্তা বলে আসছে।
– জানি না মামণি। কিন্তু তুমি যদি এই সব টুকু নুডলস শেষ করো তাহলে তোমাকে মানুষের রগ আর ধমনীর নুডলস করে খাওয়াবো।
– ইয়েএএ
হ্যাঁ দেখতে দেখতে পাঁচটি বছর কেটে গেলো।
এবং সাদ সাহেব বুঝতে পারেন নিশি অন্যসব মেয়েদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা।
তাই তিনি নিশিকে সব সময় চোখে চোখেই রাখেন।
কিন্তু নিশির কন্ঠ হয়েছে বেশ মিষ্টি,অনেকটা কোকিলের স্বর যাকে বলে। আর খুব শান্ত স্বভাব তার।
এই পর্যন্ত নিশির যতবার ঘুম ভেঙ্গেছে, সে কখনো কাঁদেনি। অন্যান্য বাচ্চারা দিনে যেখানে ছত্রিশবার কান্না করে সেখানে নিশি একবারও কান্না করে নি।
ঘটনাটি সাদ সাহেব লক্ষ্য করলেও সেদিকে তেমন একটা ধ্যান দেন নি তিনি।
সাদ সাহেব অনেকবার চেষ্টা করেছেন নিশিকে বাহিরে ফেলে আসার। কিন্তু নিশাতের কথা মনে পড়ায় আর এমনটি করার সাহস তার মনে জুটলো না।
………..
একদিন দিনের বেলায় ঘরে চোর আসে,নিশি হাঁটতে শিখেছে সবে।
সাদ সাহেব তা বুঝতে পেরে এক কোণে লুকিয়ে ছিলেন, যেই চোর নিশির রুমে প্রবেশ করলো, সাদ সাহেব পেছন থেকে একটা ফুলের টপ দিয়ে জোরে আঘাত করেন। সাথে সাথেই সে মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে । আর মাথা ফেটে রক্ত বের হতে শুরু করে।
রক্ত গড়িয়ে নিশির খাট অব্দি পৌঁছে যায়। ঠিন তখনই নিশির হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে হামাগুড়ি দিয়ে ফ্লোরে নেমে রক্তের উপর বসে পড়ে। আর সে যতখানি সম্ভব রক্ত হাত দিয়ে তুলে রক্তের স্বাদ নিতে লাগলো।
সাদ সাহেব তাড়াতাড়ি আয়াকে ডেকে সেখান থেকে নিশিকে সরিয়ে আনে। আর পুলিশে ইনফ্রম করে দেন।
সাদ সাহেব প্রথমে এটিকে খুব সাধারণ ভাবে নেন।
কিন্তু ঘটনা ঘটলো এর পরের দিন।
সকালে আয়া নিশিকে যেই খাবার মুখে খাবার তুলে দিয়েছিলো, তার ডান হাতের কব্জির রগ বরাবর নিশি সেখানে কামড় বসিয়ে দেয়।
এবং যতক্ষণ না পর্যন্ত রক্ত বেরিয়ে আসছে ততক্ষণ কামড়ে ধরে ছিলো। নিশির চোখ গুলোও খুব কালচে বর্ণের হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। আয়া তা দেখে খুব জোরে চিৎকার করে।
সাদ সাহেব নিশির রুমে ঢুকতে যাবেন এমন সময় আয়া তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়, আর সেখানে কাজ করবে না বলে চিৎকার করতে করতে পালিয়ে যায়।
সাদ সাহেব নিশির দিকে তাকিয়ে দেখেন নিশি চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে।
আর তার বিছানায় ছিলো ফোটা ফোটা রক্ত। কিন্ত তার শরীরে কোন রক্তের দাগ নেই।
নিশির হাত পেছনে, সে কিছু একটা লুকোতে চায়ছে। সাদ সাহেব নিশির পেছনে গিয়ে দেখেন, নিশির হাতে একটি রুমালের মতো কাপড় আর সে এটা দিয়ে কিছু একটি ঢাকতে চায়ছে।
সাদ সাহেব রুমালটি হাতে নিতেই খেয়াল করলেন রুমালটি রক্তে ভেজা আর সেটি খুলতেই সেখানের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হাতের আঙ্গুল।
সাদ সাহেব সেদিন খুব ঘাবড়ে যান। এতো ছোট্ট বয়সে এতো হিংস্রতা তার মেয়ের মাঝে দেখে।
এরপর আজ তার ৫ বছর, এর মাঝে অনেক ঘটনায় ঘটেছে, যেমন বাসার ছাদের কবুতরের মাথা হাত দিয়ে টেনে ছিড়ে ফেলা, জীবিত টিকটিকে ব্লেন্ডার মেশিনে ব্লেন্ড করা তার চেয়ে বেশি অবাক করার বিষয় হলো সে তার কন্ঠে একটা সুর তৈরি করেছে যা সে গুণ গুণ করে গায়লেই কোথা থেকে যেনো সব বড় বড় ইঁদুর চলে আসতো আর তার সে এগুলোকে খুব বিশ্রী ভাবে হত্যা করতো।
তার এসব অভ্যাস পরিবর্তন করতে তিনি তাকে সব সময় বাসার খাবারে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কয়েকদিন ঠিক থাকলেও আবার সে আগের মতো আচরণ করে। সাদ সাহেব চায়লে বড় বড় ভালো ডক্টর দেখাতে পারতেন। কিন্তু কেনো যেনো তিনি সবার থেকে আড়াল করে রাখতে চায়লেন নিশিকে।
বাসায় এই পর্যন্ত অনেক আয়া রাখা হয়েছে, কিন্তু নিশির অত্যাচারে কেউ বেশিদিন টিকে নি।
……………..
আজকে সাদ সাহেদ মানুষের রগের নুডলসের কথা শুনে বেশ বিপাকে পড়লেন।
যে করেই হোক তার ধ্যান হটাতে হবে।
নিশি কখনো সাদ সাহেবের কাছে কোন কিছুর বায়না করে নি বা কোন কিছু খোঁজেও নি। অবশ্য তার প্রয়োজন পড়ে না। মনে মনে নিশিকে ঘেন্না করলেও উপরে নিশির সাথে সব সময় ভালো সময় কাটান সাদ সাহেব।
সাদ সাহেব নিশি বলে ডাক দিলেন। নিশি শুধু চোখ তুলে তাকালো,
– তোমাকে আজকে একটি জিনিস দিবো।
– কি?
পকেট থেকে নিশাতের খ্রিস্ট লকেটটি বের করে তিনি নিশির গলায় পরিয়ে দেন।
– এটা তোমার মায়ের কথাটি বলে তিনি নিশিকে অনেক গল্প শোনান তিনি,নিশি শুধু চুপচাপ শুনে যায়।
কারণ তার মাথায় শুধু এখন একটি জিনিসই ঘুরপাক খাচ্ছে,যে করেই হোক মানুষের রগের নুডলস খেতেই হবে।
রাতে নিশি ঘুমিয়েছে কি না তা দেখতে সাদ সাহেব রুমে প্রবেশ করলে, সেখানে নিশিকে দেখতে পান নি।
হঠাৎ তার বুকটি ধুক করে উঠে।
“এতো রাতে কোথায় গেলো নিশি”!
সারা বাড়ি খুঁজেও তিনি নিশিকে পান নি।
এক সময় মনে পড়ে ছাদে দেখা হয় নি,
ছাদের কাছাকাছি যেতেই সাদ সাহেব নিশির কন্ঠ শুনতে পায়।
কার সাথে যেনো ঝগড়া করছে সে।
সাদ সাহেব ছাদের দরজার আড়ালে লুকিয়ে শুনছেন,
– কি হলো তোমাদের? তোমরা চুপ কেনো! তোমাদের বলেছিলাম আমার জন্যে একটা মানুষ এনে দিতে তাও পারলে না? এখন আমি রগের নুডলস কি দিয়ে খাবো?
সাদ সাহেবের মাথা বেয়ে ঘাম ঝড়তে শুরু হলো। নিজেকে আড়ালে রেখে ছাদে একটু উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করেন।
তিনি দেখতে পান কয়েকটা বাদুড় ছাদের রেলিং-এ বসে আছে আর ডানা নাড়ছে।
হঠাৎ-ই ধপাস করে একটা বাদুড়কে ঝাপটে মেরে ধরে ফেলে নিশি। বাকিসব বাদুড় উড়ে পালিয়ে যায়।
নিশির হাতে থাকা বাদুড়টি খুব ছটফট করছিলো আর চেচাচ্ছিলো। তবে বেশিক্ষণ ছটফট করতে হয় নি তার। নিশি একটি বড় হা করেই বাড়ুদের মাথাটি এক কামড়ে ছিঁড়ে ফেলে।
দেহটি মাটিতে ফেলে দিতেই তা উড়াল দেওয়ার চেষ্টা করে।
কাটা মুরগীর মতো ছটফট আর ঘুরপাক খেতে খেতে এক সময় প্রাণ চলে যায়। নিশি দরজার দিকে তাকাতেই সাদ সাহেব সরে আসেন। নিশির মুখ দিয়ে কালচে বর্ণের রক্ত পড়ছিলো। সাদ সাহেব ঘেন্নায় সেদিকে আর দেখতে পারেন নি। কিন্তু শব্দ শুনে মনে হয়েছিলো নিশি বাদুড়টির বাকি অংশ গুলোও খেয়ে ফেলছে