গ্লেন ম্যাকগ্রা ক্রিকেটের এক রাজপুত্র

গ্লেন ম্যাকগ্রা মাঠে এবং মাঠের বাইরে সবদিকেই ছিলেন সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। ক্রিকেট মাঠে যেমন তিনি সবাইকে পিছনে ফেলেছেন, তেমনি ক্রিকেটের বাহিরেও তেমনটাই করেছেন। ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা পেস বোলার ম্যাকগ্রা ছিলেন উজ্জ্বল এক নক্ষত্র। ২০০৭ সালে ক্রিকেট ছাড়লেও গ্লেন ম্যাকগ্রা অসংখ্য রেকর্ড নিজের করে রেখেছেন। সদা হাস্যউজ্জ্বল থাকা ম্যাকগ্রা ভালো মনের মানুষদের জন্য এক দৃষ্টান্ত ছিলেন। তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে না হয় পরেই আলোচনায় আসা যাক। আগে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু জেনে নেওয়া যাক।

১৯৯৫ সালে জেনি নামক একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হয় ম্যাকগ্রার। প্রথমে দেখায় বন্ধুত্ব তারপর তাঁদের সম্পর্ক রূপ নেয় প্রমের। ম্যাকগ্রা আর জেনি যখন গভীর প্রেমে আচ্ছন্ন তখন জেনি জানতে পারলো যে তাঁর ক্যান্সার হয়েছে। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর জেনি ম্যাকগ্রা কে অনেকবার বলেছে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও যার কোনো ভবিষ্যৎ নেই তাঁর সাথে থেকে কি করবে। কিন্তুু ম্যাকগ্রার ছিলো অন্য কথা, সেই সময় একজন তারকা খেলোয়ার হওয়ার পরেও ক্যান্সারে আক্রান্ত জেনির সাথে ১৯৯৯ সালে বিয়ে করেন তিনি।
অনেক সময় স্ত্রী অসুস্থ্য থাকতেন তারপরও সকল বাধাঁ-বিপত্তি ও প্রতিকূলতা কে জয় করে মনে গভীর সাহস নিয়ে বুক চিতিয়ে মাঠে লড়াই করে গেছেন। মাঠ থেকে ফিরেই সময় দিয়েছেন নিজের প্রথম ভালোবাসার মানুষকে।

২০০৭ সালে ক্রিকেট কে বিদায় জানান ম্যাকগ্রা। তিনি ক্রিকেট কে বিদায় জানানোর পর ২০০৮ সালে জেনিও গ্লেন ম্যাকগ্রা কে বিদায় জানিয়ে পরপারে চলো যায়। জেনির মৃতূর পর তাঁর শোকে অনেক ভেঙ্গে পড়েন ম্যাকগ্রা। তবে পরবর্তীতে সেই শোক কে শক্তি বানিয়ে তৈরি করলেন একটা সংগঠন। যে সংগঠনের কাজ হলো ক্যান্সারে সম্পর্কে সকলকে অবহিত করা। ২০০৯ সাল থেকে শুরু হওয়া সেই ম্যাকগ্রা সংগঠনটি ইতিমধ্যেই বিশ্বের সব দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৫০০০+ মানুষের কাছে এর কার্যক্রম হয়েছে।

কাহিনী টা পড়ে হয়তো বুঝে গেছেন উনি কেমন অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। সেই সময় অজি দলের একজন বড় তারকা হওয়া সত্বেও তিনি একজন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। আমি মনে করি তাঁর ব্যাক্তিত্ব প্রমাণের জন্য এই কাহিনীটাই যথেষ্ট। এর বাহিরে আর বেশি কিছু বলার চেষ্টা করলাম না।

এবার আসি তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনে। তিনি যখন ক্রিকেট খেলা শুরু করেন তখন অনেকেই বলেছিলেন তাঁর শরীর নাকি একজন পেস বোলারের জন্যে আদর্শ না। কিন্তুু পরবর্তীতে তিনি প্রমাণ করেন যে শরীরের জোরই সবকিছু নয়। ম্যাকগ্রা সেই যুগে ব্রেটলি, শোয়েব আক্তারদের মতোন তেমন গতিশীল পেস বোলার ছিলেন না। তবে তাঁর বোলিংয়ে ছিলো অনেক মনোযোগী একটা ভাব, বলের পর বল ওভারের পর ওভার সে উইকেট টু উইকেট বল করতো পারতো, যেটা তখন সারা ক্রিকেট বিশ্বে কারো মধ্যেই ছিলো না। আর মূলত দুই দিকেই সুইং করানো টা ছিলো তাঁর সেরা অস্ত্র। তাঁর সেরা পেস বোলার হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিলো তাঁর নিখুঁত লাইন লেন্থ।

অজি দলের ওপেনিং বোলার ছিলেন ম্যাকগ্রা। সেই কালে বিশ্বের সেরা সেরা ব্যাটসম্যানেরা তাঁর বল খেলতে অনেক ভয় পেতো।
সময়ের সেরা ব্যাটসম্যানরা তাঁকে খেলতে আন ইজি ফিল করতো।
সেই কালের বিশ্ব বিখ্যাত ব্যাটসম্যান ব্রায়ান লারার মতে,
যখন ম্যাকগ্রা ৬ ওভারের বোলিং স্পেল করতো, আমি তখন তাঁর বলে ১০ বল খেলতাম বাকি ২৬ বল চন্দ্রপলকে খেলতে বলতাম। তাঁর বলে খেলতে আমি এতো টাই আন ইজি থাকতাম।

এবার আসুন এক নজরে দেখে নেয়া যাক গ্লেন ম্যাকগ্রার অসংখ্য রেকর্ড সমূহঃ-
★সর্বোচ্চ উইকেট কোন পেস বোলার হিসেবেঃ-
–গ্লেন ম্যাকগ্রা ৯৪৯ উইকেট!
★টেস্টে ২য় সর্বোচ্চ উইকেট পেস বোলার হিসেবেঃ-
–গ্লেন ম্যাকগ্রা ৫৬০ উইকেট! (কিাছুদিন আগে অ্যান্ডারসন তাঁর রেকর্ডটি ভেঙেছেন)
★বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেটঃ-
–গ্লেন ম্যাকগ্রা ৭১ উইকেট!
★বেস্ট বোলিং ইন ওয়ার্ল্ড কাপঃ-
–১৫ রানে ৭ উইকেট গ্লেন ম্যাকগ্রা (২০০৩ বিশ্বকাপে)
★কোনও বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেটঃ-
—গ্লেন ম্যাকগ্রা ২৬ উইকেট (২০০৭ বিশ্বকাপে)
★সর্বোচ্চ সংখ্যক ব্যাটসম্যানকে ডাক মারানোঃ-১০৪ জন! ১০৪ জন ব্যাটসম্যান কে ডাক মারিয়ে প্যাভিলিয়নে পাঠান ম্যাকগ্রা।
★সর্বোচ্চ সংখ্যক ওপেনার আউটঃ-
—গ্লেন ম্যাকগ্রা ১৫৫ জন ওপেনার কে তাঁর গোটা ক্যারিয়ারে আউট করেছেন।
★সবচেয়ে বেশি উইকেট কিপারের সাহায্যে ডিসমিসেলঃ-
—গ্লেন ম্যাকগ্রা ১৫২ জন কে উইকেট কিপারের সাহায্যে তালুবন্দি করেছেন।
★প্রথম অস্ট্রলিয়ান হিসেবে ক্রিকেটের ৩ ফর্মেটেই রাংকিংএ শীর্ষে ওঠার কৃর্তীও গ্লেন ম্যাকগ্রার দখলে।

ম্যাকগ্রা তাঁর পুরা ক্যারিয়ারে মোট ৪ টা বিশ্বকাপ খেলে ৩ টা তেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে অস্ট্রেলিয়া। রানার্স অ্যাপ হয়েছে বাকি একটি তে।
★তাছাড়াও গ্লেন ম্যাকগ্রা ভিন্ন একটা বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন সেটা হয়তো কারো পক্ষেই কখনো ভাঙ্গা সম্ভন নয়। হয়তো বিরাট কোহলি শচীনের ১০০ টা শতকের রেকর্ড ভেঙ্গে দেবে, তবে ম্যাকগ্রার রেকর্ড সারাজীবন রয়েই যাবে।
★তাঁর সেই অনন্য বিশ্বরেকর্ড টি হলোঃ-
প্রতিটা ফর্মেটেই ক্যারিয়ারের শেষ বলে উইকেট নিয়েছেন তিনি। অনেকেই এটাকে কাকতালীয় বললেও এটাই সত্যি যে টেস্ট, ওডিআই এবং টি-টোয়েন্টি এই ৩ ফর্মেটেই ক্যারিয়ারের শেষ বলে উইকেট তুলে নিয়েছেন।

যেখানে অস্ট্রলিয়ান ক্রিকেটাররা এট্যাকিং থাকে। বিশেষ করে বোলাররা অধিকাংশই ব্যাটসম্যানদের স্লেজিং করে ব্যাটসম্যানদের মনোযোগ বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করেন সেখানে ম্যাকগ্রা ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির।

★সদা হাস্যউজ্জ্বল এই মানুষটাকে নিয়ে আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না কিন্তুু!!!

লিখেছেন – সোহেল খান