তেতুল তলা ২য় পর্ব

বিকেলে বাসার জন্য ডিম কিনতে গিয়ে দেখি তেতুল তলার দিকে যাচ্ছে সবাই আর বলাবলি করছে মিন্টু ভাইকে কে জানি মেরে তেতুল তলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে!….

মিন্টু ভাই এলাকায় মোটামুটি পরিচিত একজন ব্যাক্তি, বছর তিনেক হয়েছে বিয়ে করেছেন তবে এখনো সন্তান হয়নি তার। মিন্টু ভাইয়েরা আমাদের এলাকায় স্থানীয় না তবে অনেক পুরনো ভাড়াটিয়া তারা, আমি ছোট থেকেই তাদের দেখে এসেছি। পুলিশ যাদের থানায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাদের আজ সবাইকে নিয়েও এসেছেন। কারণ তাদের ভিতর কেউ খুনি হলে আজ মিন্টু ভাইয়ের লাশ তেতুল গাছে ঝুলত না!সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের বড় কর্মকর্তার গাড়ি এসে থামলো ঠিক রহিম চাচার বাসার সামনেই।অফিসার গাড়ি থেকে নামার আগে তার গাড়ির দরজার সম্মুখে এস. আই কনস্টেবল এসে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন তার গাড়ি থেকে নামার অপেক্ষায়। বোঝাই যাচ্ছে খুব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তিনি, গাড়ি থেকে নেমেই সোজা চলে গেলেন রহিম চাচার বাসায়!

আমরা নিস্তব্ধ হয়ে সবাই তাকিয়ে আছি রহিম চাচার বাসার দিকে, সবার মনে একটাই প্রশ্ন যে রহিম চাচার বাসায় পুলিশ কেনো! তাহলে কি তিনি খুন করেছেন এতোদিন! প্রশ্ন দিয়ে যে প্রশ্ন বাড়বে এটাও স্বাভাবিক। রহিম চাচা আর্মি অফিসার হয়ে এমন কাজ করলেন! কিন্তু কেনো করলেন! সবার চোখ রহিম চাচার বাড়ির দিকে আর আমি এখন তাকিয়ে আছি পাগলটার দিকে। পাগলটা ঘুমিয়ে আছে, গায়ে নোংরা কাপড়, রোদে পুড়ে যাওয়া লাল চুল যার যত্ন না নেয়ায় জট বেঁধে আছে। ঘুমিয়ে থাকায় পাগলটাকে কেমন যেনো মায়াবী মনে হচ্ছে,

মনে হচ্ছে সিমিন থাকলেও ওরে ঠিক এমনই লাগবে! সিমিনের কথা মনে পরতেই বুক কেমন ধড়ফড় করে উঠছে আমার। তাহলে কি এটাই সিমিন! কিন্তু কি থেকে কি হচ্ছে এসব! সিমিনের এমন অবস্থা কেনো হবে! আর রহিম চাচার বাড়িতে এতো পুলিশ কেনো এলো! পুরো এলাকা এখন উৎসুক জনতা, সিমিনদের বাসার চারপাশে জমায়েত হয়ে তাকিয়ে আছে সবাই। দু’একজন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ রহিম চাচার বাসায় যেতে চাইলে পুলিশ তাদের বাধা দিচ্ছে।

ভিড় জমানো মানুষ গুলোকেও দূরে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে কিন্তু কেউ দু’এক কদমের বেশি সরছে না কারণ সবাই মন ভর্তি প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে, যার উত্তর কেউ হয়তো এখন পাবে না কিন্তু চোখের অনুমান নিয়ে প্রশ্নের উত্তর মিলাবে বলে অপেক্ষায়… তেতুল তলা থেকে এখনো মিন্টু ভাইয়ের লাশ হাসপাতালে নেয়া হয়নি। এর আগের পাওয়া লাশ গুলো এতো সময় রাখা হয়নি। সবার মিনিট ত্রিশেক অপেক্ষার প্রহর বোধহয় শেষ হয়ে এলো, পুলিশ বের হয়ে আসছে সিমিনদের বাসা থেকে। ধীরে ধীরে রহিম চাচাকেও দেখা যাচ্ছে সেই বড় কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে বলতে বের হচ্ছেন তিনি। কিন্তু সবাই খুব আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে কারণ রহিম চাচা আর অফিসার বেশ হাস্যজ্বল ভাবে কথা বলতে বলতে বের হচ্ছেন দুজন। যদিও হাসিটা অন্য দিনের মতো সাধারণ নয় কারণ এলাকায় লাগাতার মানুষ খুন হওয়ায় সবার মুখই ইদানীংকালে কিছুটা শুকনো। পুরো এলাকা রহিম চাচার হাসিতে যেনো স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো।

কেউ জানে না তাঁর বাসায় পুলিশ কেনো আসলো, তবে সবই নিজেদের বুদ্ধি দিয়ে বলাবলি করছে যে রহিম চাচা রিটায়ার্ড প্রাপ্ত আর্মি অফিসার তাই তার সাথে পুলিশের বড় কর্মকর্তাদের ভালো পরিচয় থাকবে এটাই স্বাভাবিক। রহিম চাচাকে সাথে নিয়ে সব পুলিশ কর্মকর্তারা তেতুল তলায় পৌঁছেছেন। মিন্টু ভাইয়ের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে, দু’একজন পুলিশ বাদে ধীরে ধীরে অন্যসব পুলিশও চলে গেছেন। বাড়ির দিকে আসছেন রহিম চাচা, কিন্তু তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে গেছেন এলাকার বাচ্চা থেকে মুরব্বি সবাই। সবাই যে যা আন্দাজ করলেও মুখে এখন একটাই প্রশ্ন, “কি হয়েছিল!” রহিম চাচা দাঁড়িয়ে গেলেন তাদের সম্মুখে, সবাইকে বললেন তার সাথে ওই কর্মকর্তার ভালো বন্ধুত্ব রয়েছে। যার দরুন এলাকায় মানুষ খুন হওয়ায় তার সাথে কথা বলতে এসেছে কাউকে সন্দেহ হয় কিনা সে বিষয় জানতে। “তা আপনি কি বললেন? কেউ কি আছে যার উপর আপনার সন্দেহ হয়?” (মকবুল চাচা প্রশ্ন করলেন) “ভাই আমরা তো আইনের মানুষ আইন নিয়ে কাজ করেছি আমাদের চোখে সন্দেহের পাত্রের অভাব নেই। কিন্তু খুন দেখে বোঝা যাচ্ছে খুনী কিছু একটা বুঝাতে চাইছে তাই সন্দেহ করার আগে খুনীর বার্তাটা জানা জরুরী। শুনলাম ঢাকা থেকে নাকি স্পেশাল অফিসার এসেছেন যে ইতমধ্যে এলাকায় অবস্থান করছেন এবং সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছেন।

আপনারা কারো সাথে কোনো রকম ঝামেলায় জড়াবেন না আর অপরিচিত মানুষ দেখলে তাদের সাথে খারাপ আচরণ করবেন না।” কথাগুলো বলে রহিম চাচা তার বাড়ির ভিতর চলে গেলো, ধীরে ধীরে লোকসমাগম কমতে শুরু করলো। আমিও বাসায় চলে এলাম, কেন জানিনা পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। রহিম চাচা যে খুনী নন তা কেউ বলতে পারবে না আর কে খুনী তাও কেউ বলতে পারবে না তবে সবাই একটু আগে তার বাসায় পুলিশ দেখে যা ভেবেছিল ওই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য এখন ভিন্নরকম পরিবেশ বিরাজমান হচ্ছে। রাত আনুমানিক দুটো বাজে, তেতুল তলার কাছ থেকে একটা মেয়ের চিৎকার শোনা যাচ্ছে! অন্য সময় হলে সবাই চিৎকারের শব্দ শুনে কোথা হতে শব্দ ভেসে আসছে তা নিয়ে বিচলিত হতো৷ কিন্তু কয়েকদিন ধরে সবাই তেতুল তলায় যাতায়াত আর ওদিকের ভাবনায় থাকার কারণে বুঝতে বেশি কষ্ট হয়নি যে চিৎকার তেতুল তলার দিক থেকেই ভেসে আসছে!….

কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে কেউ বাসা থেকে নামছেন না! চিৎকারের শব্দ ধীরে ধীরে সব বাড়ির অন্ধকার ঘুচে লাইট জ্বলে আলোকিত হয়ে গিয়েছে। সবাই যে যার জানালায় অবস্থান করছেন, দরজাটা পর্যন্ত কেউ খুলছে না। একজন অন্যজনের সাথে ফোনে কথা বলে বিষয়টা ধীরে ধীরে যারা ঘুমিয়ে ছিলেন বা এলাকার বাহিরে আছেন তাদের কাছেও ছড়িয়ে গেছেন কিন্তু কেউ বাসা থেকে নামছে না! এক এক করে চারটি শক্তপোক্ত মাঝ বয়সী যুবক ছেলের খুন হয়েছে তেতুল তলায় যার কারণে ভয় এতোই গ্রাস করেছে যে কেউ সাহস করে যেতেই পারছে না চিৎকার করা মেয়েটি কে বা কেন চিৎকার করছে এটা দেখতে….

দূর থেকে কে যেনো আসছে তেতুল তলার দিক থেকে, বেশ জোরে হাঁটতে হাঁটতে আসছেন। হাতে একটা টর্চ লাইট দেখা যাচ্ছে আর কাঁধে সাদা রঙের মোটা রশি! যে চারজন খুন হয়েছে তারা এরকম মোটা রশিতেই ঝুলছিল! লোকটার হাঁটার গতিবিধি দেখে অনেকটা পরিচিত মনে হচ্ছে। তাহলে কি!…..