বয়সতো অনেক হয়েছে। আমার বর্তমান বয়স প্রায় ৫০ পেরিয়ে ৬০ এর কাছাকাছি। এখন না আছে শরীরে সেই আগের মতো লেখার শক্তি। না আছে মস্তিস্কে আগের মতো চিন্তা করার শক্তি। তাও আজ ৩টা ঈদ কার্ড আর ৩টা চিঠি নিয়ে বসেছি। যে করেই হোক আজ আমাকে ৩টা চিঠি লিখে ৩টা ঈদ কার্ডের সাথে যুক্ত করে সৃষ্টিকর্তার কাছে পাঠাতেই হবে। আজ চাঁদ রাত আর কালকে ঈদ। ঈদ মানে খুশি। মানুষ যখন খুশি থাকে তখন তার কাছে যা আবদার করা হয় তাই সে রাখার চেষ্টা করে। মানুষ সৃষ্টিকর্তা থেকেই শিখে। নিশ্চই সৃষ্টিকর্তাও এর ব্যাতিক্রম না। ঈদের আনন্দে হয়তো সৃষ্টিকর্তাও আজ অনেক খুশি । তাই আমার মনে হয় আমার আজকের আবদারটা সৃষ্টিকর্তা আর ফেলতে পারবেন না। আসলে আমার আজকের আবদারগুলো একটু ভিন্নরকম। আজ চাঁদরাত অর্থাৎ কালকে ঈদ। কিন্তু এখনকার ঈদগুলো আর আমার কাছে তেমন ভালো লাগে না। আমার জীবনের সেরা ঈদ কেটেছিলো সেই শৈশব,কৈশর,যৌবন আর বৃদ্ধ বয়সের প্রথম ঈদ গুলোতেই। তখনকার ঈদগুলোর কথা আমি মরার পরেও হাজার বছর মনে রাখবো। কিন্তু এখনকার ঈদগুলো আর তেমন ভালো লাগে না। তাই আজ আমি এই ৩টা চিঠি, ৩টা ঈদ কার্ডের সাথে যুক্ত করে আমার শৈশব, কৈশর আর যৌবন বয়সের কাছে পাঠিয়ে তাদেরকে ঈদের দাওয়াত দিবো। আমি চাই কালকের ঈদটাতে আমার কাছে আমার শৈশব,কৈশর আর যৌবন বয়সের ঈদের আনন্দ একসাথে মিশে আমার ঈদের আনন্দটাকে আরো কয়েকগুন বাড়িয়ে দিবে। আমি প্রথম চিঠিটা লিখবো আমার শৈশবকে:
.
চিঠি-১ :
.
প্রিয় শৈশব,
কেমন আছো তুমি? জানি আমাকে পৃথিবীতে একা ফেলে রেখে ভালোই আছো তুমি! সবাই বলে একেকটা মানুষের শৈশব নাকি একেকটা উপন্যাসের সমান। কিন্তূ আমার কাছে আমার শৈশবতো কয়েক হাজার উপন্যাসের চেয়েও বড়। প্রিয় শৈশব, তুমি কি জানো যে কাল ঈদ? ঐ যে আমাকে কৈশরের হাতে তুলে দিয়ে চলে গেলে?এরপরেতো আর একটা ঈদেও আমার খোজ নিতে এলে না? আমার জীবনের শেষ্ঠ ঈদগুলো আমি কাটিয়েছি তোমার মাঝেই। মনে কি পরে সেই ঈদের দিনগুলোর কথা? তখন আমার বয়স আর কত? ৬ বা ৭ বছর! চাঁদরাতে বাড়ির উঠানে,রাস্তায় ভাই বোন আর বাল্ব বন্ধুরা মিলে ছুটাছুটি করতাম ঈদের চাঁদ দেখার জন্য। যেই চাঁদটা দেখতাম আমাদের আনন্দ আর ধরে কে? দৌড়ে পুরো গ্রামকে জানিয়ে দিতাম যে কালকে ঈদ। চাঁদ মামা আকাশে ঈদের সংবাদ নিয়ে এসেছে! মা বলতো ঈদের চাঁদকে নাকি সালাম দিতে হয়। তাই সবার প্রথমে আমিই চাঁদ মামাকে সালামটা দিতাম। চাঁদ মামা জবাবটা দিতো কিনা তা ঠিক মনে নেই আমার! এরপরেই বাড়ির মহিলারা ব্যাস্ত হয়ে পড়তো পিঠা তৈরি নিয়ে আর মেহেদী নিয়ে। খালা আর ফুফুরা মিলে জোর করেই হাতে মেহেদী দিয়ে দিতো। এরপর চাঁদরাতে ঘড়ির কাটায় যখন রাত এগাড়োটা তখন মার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করতাম, মা এখন কি ঈদ? মা বলতো , না বাবা। আরো ১ ঘন্টা পরে কালকে ঈদ। তখন কতো আনন্দ লাগতো! একাই ছড়া কাটতাম , “এক দুই তিন, কালকে ঈদের দিন।” কতো মজা লাগতো তখন! এরপর সবার সাথে ঘুমিয়ে পড়তাম । যখন রাত ২টা বা ৩টা বাজে তখন আবার ঈদের আনন্দে ঘুম ভেঙে যেতো। ঘুম থেকে উঠে মাকে ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞেস করতাম, মা! এখন কি ঈদ? মা মুচকি হেসে উত্তর দিতো, হ্যাঁ বাবা। এখন ঈদ। তখন আমার আনন্দ আর দেখতো কে? আবার ছড়া কাটা শুরু করতাম , “এক দুই সাড়ে তিন, রাত পোহালেই ঈদের দিন।” কত মজাই ছিলো সে ভোরটা! এরপর আবার ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুম ভাঙতো মায়ের মিষ্টি কন্ঠে, খোকা? সকাল হয়েছে। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠ! সূর্য মামা উঠার আগে গোসল করলে বেশি সওয়াব হয়। এরপর আমি আবার ঘুম থেকে উঠে সবার আগে গোসল করে নিতাম। এরপর আলমারিতে লুকিয়ে রাখা আমার সেই মহামুল্যবান ঈদের জামাটা বের করে মা পরিয়ে দিতো। ঈদের জামাটা কেনা থাকতো ১৫-২০ দিন আগেই। কিন্তু ঈদের আগে কাউকে সেটা দেখাতাম না। কারণ ঈদের আগে ঈদের জামা কাউকে দেখালে নাকি সেটা পুরোনো হয়ে যায়। এরপর নতুন জামা পরে অনেক্ষন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের সোন্দর্যতাটা উপভোগ করতাম। মা তখন চোখে কাজল আর কপালে বড় একটা টিপ দিয়ে দিতো। এরপর মায়ের হাতে রান্না করা সেমাই খেয়ে বাবার হাত ধরে রওনা দিতাম ঈদের নামাজ পড়তে। যদিও আমি তখন নামাজ পড়তে পারতাম না কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগতো এই ঈদের নামাজটাই। কারণ হাজার হাজার পরিচিত-অপরিচিত মানুষ একত্রে মিলিত হতো তখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ পড়বে বলে। নামাজ শেষে দোয়ার পরেই সবাই একে অপরের সাথে বুক মিলিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতো। আমিও মজা করে আমার খেলার বন্ধু বা ভাইদের সাথে কোলাকুলি করে ভাব করতাম। এরপর শুরু হতো আমাদের ঈদের মজা। আমি এবং আমার ভাই বোনেরা মিলে আশেপাশের চেনা-পরিচিত আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে যেতাম। নানান রকমের পিঠা,পায়েস,সেমাই খেতাম। সবচেয়ে মজার বিষয়টা ছিলো তখন সালামি পাওয়া। সেদিন প্রায় সব বড় আত্মীয়েরাই সালামি দিতো আমাদের। সেদিন যেনো নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়লোক বলে মনে হতো। ইচ্ছামত এলাকায় ঘুরতাম,যা খুশি তাই কিনতাম। বাবা-মাও আর কোন বাঁধা দিতো না। ঈদের দিনটা অনেক ভালোভাবেই কাটতো। এরপর সন্ধ্যাঁবেলায় বাড়িতে ফিরে মন খারাপ করে মাকে বলতাম, ইস! ঈদটা শেষ হয়ে গেলো! ঈদটা যদি আজ না হয়ে কাল হতো কতোই না মজা হতো! এরপর আবার বাবা মায়ের সাথে, সারাদিন কি কি করলাম, কি কি খেলাম , সালামি কতো পেলাম, এসব নিয়ে গল্প আর আড্ডা হতো। ভাই-বোন, বাবা-মা একসাথে মিলে কাটানো সেই ঈদের সন্ধ্যাঁর কথা যে আজো ভুলতে পারিনা। আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো ঈদ ছিলো ঐগুলো। আমার শৈশবের ঈদ। শৈশব? তুমি কি জানো যে আজও আমি তোমার কথা ভেবে চোখের জল ফেলি? এতোটা জীবন তুমি আমায় আগলে রেখেছিলো। কিন্তু এখন কেন আর আমার খোঁজ নাওনা। বৃদ্ধ হয়ে গেছি বলে? কতোটা কষ্টে আমি আছি সেটাকি তুমি জানো? আজ চাঁদরাত। কালকে আবার নতুন একটা ঈদ। এখন আর ঈদ গুলো সেই শৈশবের মতো কাটেনা। কাটবে কি করে? সেই বাবা-মা, ভাই-বোন কেউতো আর পাশে নেই এখন। সবাই বড় স্বার্থপর। আমায় একা ফেলে রেখে ওপারের দুনিয়ার অতিথী হয়েছে তারা। নিজের হাতে কবরে শুইয়ে এসেছি সবাইকে। তাদের কথা মনে হলেই খুব কান্না পায়। তুমিতো আর তাদের ফিরিয়ে আনতে পারবে না। তাই একাই কাল চলে এসো আমার কাছে। আমার সেই শৈশবের ঈদের আনন্দের খানিকটা দিয়ো আমার মাঝেও।
.
ইতি,
তোমার মধ্যে হেসে খেলে বড় হওয়া সেই ছেলেটি।
.
চিঠিটা লিখতে লিখতেই চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। চিঠিটা লিখতে লিখতে কখন যেনো সেই অতীতের দিনগুলোতে হারিয়ে গিয়েছিলাম নিজেই জানি না। এরপর আরো একটা চিঠি লেখা শুরু করলাম। এবার চিঠিটা আমার কৈশরকে লেখা:
.
চিঠি:-২
.
প্রিয় কৈশর,
কেমন আছো তুমি? শৈশবের মতো নিশ্চই তুমিও অনেক ভালো আছো? তুমি কি জানো যে কালকে ঈদ? হয়তো জানো। কিন্তু আমার কথাতো আর তোমার মনে নেই! সেই যে আমাকে যৌবনের হাতে তুলে দিয়ে চলে গেলে আরতো খোঁজ নিতে এলেনা। আমার জীবনে ঈদের আনন্দ হাজারগুন বাড়িয়ে আমাকেতো ঈদের মানেটা শিখিয়েছিলে তুমিই। সবাই বলে কৈশর হলো নিজেকে প্রকাশ করে জানার বয়স। এই সময়টাতে আমাকে ঈদের এক অন্য আনন্দে ডুবিয়ে রাখতে তুমি। মনে কি পড়ে সেই দিনগুলোর কথা? কৈশরে ঈদের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই ব্যাস্ত থাকতাম ঈদ কার্ড লিখে বন্ধুদের ঈদ কার্ড দিয়ে ঈদের দাওয়াত দেওয়ায় আর বন্ধুদের থেকে ঈদ কার্ডের মাধ্যমে ঈদের দাওয়াত নেওয়ায়। কতো যত্নে ছড়া লিখেই না তখন বন্ধুদের নিমন্ত্রন করতাম। এরপর যখন চাঁদরাত হতো তখন চাচাতো মামাতো ভাই বোন আর বন্ধুরা মিলে মেতে উঠতাম ঈদের আনন্দে। একসাথে মিলে বাজি ফাটিয়ে স্বাগতম জানাতাম ঈদ আর চাঁদ মামাকে। কতো হৈচি আর আনন্দের মধ্য দিয়েই না কাটতো চাঁদরাতটা! রাতে আনন্দ করে ঘুমিয়ে পড়তাম ঈদের সকালের অপেক্ষায়। বরাবরের মতোই মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙতো ঈদের সকালে। ঘুম থেকে উঠে সবার আগে গোসলটা আমিই করতাম। এরপর একটা নতুন পাঞ্জাবী আমাকেই পরতেই হবে। কৈশর তখন যেনো আমায় সৌন্দর্য্যবোধের শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছিলো। ভাবতাম সবাই যখন পাঞ্জাবী পরে নামাজ পড়তে যায় তখন আমিও পাঞ্জাবীই পড়বো। এরপর মায়ের রান্না করা সেমাই খেয়ে নামাজ পড়তে যেতাম। মা বলতো ঈদের নামাজের আগে নাকি মিষ্টিমুখ করা সুন্নাত। এরপর এলাকার সব বন্ধুরা মিলে একসাথে গল্প করতে করতে নামাজ পড়তে যেতাম। নামাজ পড়া মানেই যেনো তখন অর্ধেক ঈদের আনন্দ নিজের আয়ত্তে আনা। এরপর নামাজ শেষে বন্ধুরা একে অপরের সাথে কোলাকুলি করতে নিয়ে যাহ মজা করতাম! কেউ বা কাউকে খুব জোরে বুকে চেপে ধরতাম। আবার কেউ বা বুকে চেপে ধরে পিঠে থাপ্পর বসিয়ে দিতাম। এরপর ছুটাছুটি, হৈচি। কে দেখে কাকে? কতোই না মজা করতাম তখন! বন্ধুরা মিলে সারাদিন এপারা, ওপারা ঘুরে বেড়াতাম। কখনো বা কারো বাড়িতে গিয়ে মিষ্টি-পায়েস খেয়ে আসতাম। সালামির ব্যাপারটা তখনো আনন্দের আরেক নাম ছিলো। তখন অবশ্য সালামি যা পেতাম তার পুরোটাই ঘুরাঘুরি করে খরচ করে ফেলতাম। কৈশরের ঈদে পরিবারের সাথে কাটানো মুহুর্তগুলোও ভুলার মতো না। ঈদের দিনটা যেনো রকেটের গতিতে শেষ হয়ে যেতো। ঈদ শেষ মানেই যেনো আবার আরো একটা বছরের অপেক্ষা। প্রিয় কৈশর, কতোই না আনন্দে মাতাল করে রাখতে আমায় সেইদিনগুলোতে। সেই পরিবার , বন্ধু-বান্ধবের সাথে কাটানো ঈদগুলোর কথা ভুলি কি করে বলো? সেই বন্ধুগুলো এখন কোথায় আছে জানো? কয়েক জনের লাশের গোসল আমি নিজে হাতে করিয়েছি। কয়েকজন এখনো বিছানায় বা বিভিন্ন হাসপাতালে পরে রয়েছে। সবাই কেমন যেনো হয়ে গেছে। এখন আর তারা ঈদ করে না। আমার মতো শুধু ঈদকে অনুভব করে। তাদেরকে তো আর আগের মতো করতে পারবে না তুমি কৈশর! কিন্তু আমি আবার সেই কৈশরের ঈদের আনন্দটুকু উপভোগ করতে চাই। যতোই ব্যাস্ত থাকো না কেনো তুমি, কালকে তোমাকে অবশ্যই আসতে হবে। আবার আমার মাঝে সেই কৈশোরের ঈদের আনন্দটুকু ফিরিয়ে দিবে তুমি। তুমিতো জানো যে কালকে আরেক ঈদ। কালকের ঈদে আমার জীবনে তোমার আবার নিমন্ত্রন রইলো প্রিয় কৈশর। একটা দিনের জন্য হলেও আমার জীবনে ফিরে এসো তুমি!
.
ইতি,
তোমার মধ্যে একটা সময় ডুবে থাকা সেই কিশোরটা।
.
চিঠিটা লেখার পরেই মনে পড়ে গেলো সেই কৈশরের প্রিয় মানুষগুলো আর তাদের সাথে কাটানো মুহুর্তগুলোর কথা। সেই বন্ধুদের সাথে কাটানো ঈদগুলোর কথা মনে হতেই চোখের কোণে কয়েক ফোটা অশ্রু এসে জমা হলো। শরীরটা অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছে চিঠি ২ টা লিখতে লিখতে । এবার ৩য় এবং শেষ চিঠিটা লেখবো আমার যৌবনকে।
.
চিঠি:৩-
.
প্রিয় যৌবন,
কেমন আছো তুমি? জানি যে অতীতেরা সব সময়েই ভালো থাকে। শৈশব,কৈশরের সাথে মিশে তুমিও নিশ্চই ভালোই আছো! সেই যে আমাকে বৃদ্ধ বয়সের হাতে তুলে দিয়ে আমার জীবন থেকে ছুটি নিলে আরতো কখনো খোঁজ নিলে না। আমাকে জীবন শব্দটার সাথে পরিচয় ইতো করিয়ে দিয়েছিলে তুমি। আমার কাছে পৃথিবী আর জীবনটাকে একটা বইয়ের মতোই উপস্হাপন করেছিলে তুমি। আমার জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় আমি অতিবাহিত করেছি তোমার মাঝেই। প্রিয় যৌবন, তুমি কি জানো যে কাল ঈদ? ঈদ মানেতো খুশি তাই না? কিন্তু তুমি যে আমায় সেই বার্ধক্যে আটকে রেখে চলে গিয়েছিলে এরপর থেকে আমার কাছে খুশি নামক শব্দটি পুরোই অপরিচিত। আমার জীবনের সব অন্যরকম ঈদ কেটেছিলো এই যৌবন বয়সে। প্রিয় যৌবন, মনে কি পড়ে সেই দিনগুলোর কথা? যৌবনে আমার কাছে ঈদ মানেই যেনো ঈদের কেনাকাটা। যৌবনেই জীবনের প্রথম উপার্জন করতে শিখেছিলাম। নিজের উপার্জনের টাকা দিয়ে প্রিয় মানুষগুলোকে ঈদে উপহার দেওয়ার মধ্যে যে আনন্দ আছে, তা পৃথিবীর অন্য কিছুতে আর নেই। ঈদের আগেই অফিস থেকে বেতন আর বোনাসের টাকা পেয়ে যেতাম। সেই টাকা দিয়েই সাধ্যের মধ্যে বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবী, মায়ের জন্য শাড়ী আর ভাই বোনদের জন্য টুকটাক জামা কাপড় কিনতাম। যৌবন বয়সের মাঝেই নিজের জীবনে আগমন ঘটেছিলো কিছু নতুন সদস্যের। তাদের জন্যও ঈদের আগে নতুন জামা কাপড় কিনে নিয়ে আসতাম। তারা আর কেউ না। আমার স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে। এই যৌবন বয়সটা যেনো অন্যের আনন্দ দেখে সুখে থাকার বয়স। আমার কাছে ঈদ মানেই যেনো তখন পরিবারের মানুষগুলোর মুখে হাসি। ঈদের আগের রাত থেকে ঈদ পুরোটাই কাটতো তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে । ঈদের দিন মোয়াজ্জীনের আজানের শব্দের সাথে সাথেই ঘুমটা ভাঙতো। এরপর ওযু করে ফজরের নামাজ পড়ে সবার সাথে মিলে কবর জিয়ারতে যেতাম। এরপর বাড়িতে এসে গোসল করে পাঞ্জাবী পরে মিষ্টিমুখ করেই বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়ের সাথে চলে যেতাম সেই প্রিয় হাজারো পরিচিত-অপরিচিত মানুষের ভীরে ঈদের নামাজ পড়তে। ঈদটা যেনো ঈদের নামাজ দিয়েই শুরু হতো তখন। কতরকম মানুষ আছে এই পৃথিবীতে। সবাই সেদিন নিজেদের পরিচয় ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে যায় ঈদের নামাজ পড়তে। ঈদের নামাজ শেষে যৌবন বয়সে যেনো দায়িত্বটা অনেক বেড়ে যায়। ছেলেমেয়ে, স্ত্রী , বাবা-মা, সবার আনন্দের দায়িত্বটা যেনো আমাকেই নিতে হতো। এরপর ছোটরা এসে সালাম করতো। তাদের সালামি দেওয়ার মাঝেও যে এতোটা আনন্দ থাকে এটা এই বয়সে না আসলে বুঝতে পারতাম না। তাদের খুশিতেই তখন আমি খুশি। এরপর ঈদ যেনো দুপুর বেলাতেই ফুরিয়ে যেতো। ঈদের দিন কেনো জানি এই বয়সে ঘুম এসে চেপে ধরে। দুপুর বেলা ঘুমিয়ে পড়তাম কয়েক ঘন্টার জন্য। এরপর অবশ্য মজা হতো। পরিবারের সবাই মিলে একসাথে পোলাও মাংস, দই মিষ্টি খেতাম। এরপর টিভির ঘরের আড্ডাতো আছেই। ঈদ মানেই যেনো টিভিতে নতুন কিছু আসবে। দেখতে দেখতে ঈদের দিনটা চলে যেতো। কিন্তু দিনটাতে বাবা মা, স্ত্রী, ছেলে মেয়েদের ভালোবাসাটা একটু বেশিই পেতাম। এই বয়সের ঈদগুলোতে আনন্দ গুলো, প্রিয় মানুষগুলোর সুখেই হতো। যৌবনের বয়স যতোটা বাড়ছিলো। যৌবন ততটা বৃদ্ধ হচ্ছিলো আর আমাকেও বৃদ্ধ করছিলো। দেখতে দেখতে প্রিয় যৌবন আমার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলো। আমার বাবা-মা , স্ত্রী এবং কিছু প্রিয় আত্মীয়েরা এই যৌবনেই আমার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে ওপারের দুনিয়ায় পারি জমিয়েছিলো। এরপর দেখতে দেখতে আমার ছেলে মেয়েগুলোও অনেক বড় হয়ে গেলো। তাদেরো ছেলেমেয়ে হয়েগেলো। প্রিয় যৌবন, এরপর তুমি কি করলে? আমাকে বৃদ্ধ বয়সের হাতে তুলে দিয়ে চলে গেলে চিরোতরে আমার জীবন থেকে। আরতো আসলেনা কখনো আমার খোঁজ নিতো। এতোটা বাস্তবতার ভেতরেও কতোটাই না আনন্দে আমায় রেখেছিলে তুমি যৌবন! আমার ঈদগুলোকে কতোটাই না সুন্দর আর পবিত্র রেখেছিলে তুমি যৌবন। প্রিয় যৌবন, তুমিতো জানো যে কালকে ঈদ। তোমাকে ছাড়া আর আমার ঈদ সেই আগের মতো কাটে না। আমার নিমন্ত্রনকে ফিরিয়ে দিও না। আসা করি তুমি কালকের ঈদটা আমার সাথেই করবে আর আমাকে আবার যৌবনের ঈদের আনন্দ ফিরিয়ে দিবে।
.
ইতি,
তোমার বাস্তবতার মধ্যে বেঁচে থাকা সেই যুবকটা।
.
.
সবগুলো চিঠি এবার লেখা শেষ। এবার চিঠিগুলো ঈদ কার্ডের সাথে যুক্ত করে সৃষ্টিকর্তার কাছে শুধু পাঠানো বাকি। আমি জানি যে আমার সৃষ্টিকর্তা আজ অনেক খুশি আছেন। কারণ কালকে ঈদ। তিনি আজ আমাকে আর খালি হাতে ফিরিয়ে দিবেন না। আমার চিঠিগুলো তিনি আমার শৈশব, কৈশর আর যৌবনের কাছে পৌছে দিবেনই । আর কাল তারা এসে আমার বৃদ্ধ ঈদের আনন্দের সাথে মিশে আমার ঈদের আনন্দটাকে আরো বাড়িয়ে দিবে।
.
চিঠিগুলো আমি এতক্ষন ছাদের উপর বসে বসে লিখলাম। আমি জানি যে সৃষ্টিকর্তা অনেক উপরে থাকেন। তাই আগে থেকেই বুদ্ধি করে চিঠিগুলো তার কাছে পৌছানোর জন্য একটা মাধ্যম এনেছি। সেটা আর কিছু না। একটা “ফানুস” নিয়ে এসেছি আমি। ফানুসটার সাথে চিঠিগুলো আর ঈদকার্ড বেঁধে ফানুসের তলায় আগুন ধরিয়ে ফানুসটাকে উড়িয়ে দিলাম মুক্ত আকাশে। আমি জানি যে এই ফানুসটাই চিঠির বার্তাগুলো পৌছে দিবে সৃষ্টিকর্তার কাছে। ফানুসটার উড়া দেখে আমার নিজের উপর বিশ্বাস যেনো দিগুন হয়ে গেলো। আমার মনে হচ্ছে ফানুসটা সামনের দিকে না গিয়ে সোজা উপরে ঈদের চাঁদের দিকে যাচ্ছে। আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করলো আজ নিশ্চই ফানুসটা সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌছাবেই। হঠাৎ করেই চোখে পড়লো ঈদের চাঁদের দিকে শুধু আমার একটা ফানুস যাচ্ছে না। আরো ৫১ টা ফানুস আমার ফানুসকে সঙ্গে নিয়ে চাঁদের দিকে যাচ্ছে। এই ফানুসগুলোতেও চিঠি আর ঈদ কার্ড যুক্ত করে দেওয়া। বাকি ৫১ টা ফানুস আমার উড়ানো না। এই ফানুসগুলো আমার সাথেই উড়িয়েছে আমার বৃদ্ধাশ্রমের বন্ধুগুলো।
.
আসলে আমি একটা বৃদ্ধাশ্রমে থাকি। এখানে আমি একা থাকি না। আমার সাথে আরো ৫১ জন বৃদ্ধ থাকে। তাদের সবাইকেই আমার মতো বৃদ্ধ বয়সে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে তাদের আপনজনেরা। এর চেয়ে কষ্টের জীবনে আর কি হতে পারে যখন নিজের সন্তানদের কাছেই আমরা বোঝা হয়ে যাই এই বৃদ্ধ বয়সে! আমার নিজের ছেলে, যাকে নিয়ে আমার পৃথিবী আমি রচনা করেছিলাম। সে আর তার স্ত্রী মিলে ঠিক করেছিলো যে আমি নাকি বৃদ্ধ, আমাকে দিয়ে এখন আর সেই শৈশব,কৈশর, যৌবনের মতো আর কোন কাজ হয় না। তাই তাদের সিদ্ধান্তেই আজ আমি এই বৃদ্ধাশ্রমে। শুধু আমি না, আমার সাথে থাকা আরো ৫১ জন বুড়োও ঠিক একই ভাবে এই বৃদ্ধাশ্রমে এসেছে। এই জীবনের শেষ দিকে এসে আমরা এখানের সব বৃদ্ধরা বন্ধু হয়েছি। গত এগাড়ো বছর ধরে আমি এদের সাথেই ঈদ করছি। কিন্তু এবার আমরা সবাই মিলেই সিদ্ধান্ত নিলাম যে, না! এই বৃদ্ধ ঈদ আর করবো না। আমাদের সবার আমাদের শৈশব,কৈশর আর যৌবনের ঈদগুলো ফেরত চাই। আমরা জানি যে এই চাঁদরাতে সৃষ্টিকর্তা অনেক খুশি থাকেন। তাই আজ আমরা সবাই মিলে কালকের ঈদের জন্য আমাদের শৈশব,কৈশর আর যৌবনের ঈদকে নিমন্ত্রন করেছি। আমাদের বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তা আমাদের চিঠির মান রাখবেই।
.
.
এসব করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন আমরা ঘুমাবো। ঘুমানোর জন্য সবাই নিজের নিজের ঘরে গেলাম। ঘুমানের আগে শেষবারের মতো বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে যে, কালকের ঈদটা আমার জীবনের সেরা
ঈদ হবে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের চিঠিগুলো পাবেন। আর আবার আমাদের শৈশব,কৈশর আর যৌবনের ঈদগুলো ফিরিয়ে দিবেন। বাকি ৫১ জন বৃদ্ধও হয়তো আমার মতোই এই স্বপ্ন দেখতে দেখতেই আজ ঘুমাবে। আমি ঘুমানোর জন্য নিজের চোখ বন্ধ করলাম নতুন একটা সকালের, নতুন একটা ঈদের অপেক্ষায়।
.
.
ধুর! ঘুম আসছেনা। আবার চোখটা খুললাম। আমি মুচকি মুচকি হাসছি। আমি জানি যে এতক্ষন আমরা ৫২ জন মিলে যা কিছু করলাম তা আমাদের ছেলে মানুষী ছিলো। এই ফানুসগুলো কিছুক্ষন উড়ার পরে আবার মাটিতে লুটিয়ে পড়বে, চিঠিগুলোও হারিয়ে যাবে অজানা পৃথিবীতে। একটা লেখাও পৌছাবে না সৃষ্টিকর্তার কাছে। আমি জানি যে সৃষ্টিকর্তা চিঠি পড়েন না। তিনি তার সৃষ্টির মন পড়তে পারেন। মন পড়েই তাদের যে কোনো মনের ইচ্ছা পুরণ করে দেয়। আমি জানি যে সৃষ্টিকর্তা আজ অনেক খুশি আর তিনি আমাদের মনের ভেতর জমে থাকা আবদারটা আজ রাখবেনই। সৃষ্টিকর্তা জানেন যে আমাদের কারোই মনের আবদার এটা না যে, আমাদের জীবনে কাল আবার শৈশব,কৈশর আর যৌবনের ঈদের আনন্দ ফিরে আসুক। শুধু আমরা ৫২ জন কেনো? এই পৃথিবীর সকল বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মনে ঈদের আগের রাতে একটাই আর্তনাদ থাকে। সেটা হলো, “কাল কি আমার সন্তানটা একটাবারের জন্যও তার ঈদের আনন্দটা আমার সাথে
ভাগ করে নিতে শত ব্যাস্ততা ফেলে এই বৃদ্ধাশ্রমে আসবে? নাকি গত বছর গুলোর মতোই আমাকে ভুলেই পার করে দিবে ঈদটা?”
.
আজ আমার মনেও সেই একই আর্তনাদ। কাল কি আমার ছেলে আর মেয়ে তাদের ঈদের আনন্দ কিছুটা ভাগ করে নিতে আমার কাছে এই বৃদ্ধাশ্রমে আসবে? নাকি বাকি ১০ টা বছরের মতো আমাকে ভুলেই পার করে দিবে ঈদটা? আমি জানি যে আমার সাথের আরো ৫১ জন বৃদ্ধও এই স্বপ্ন নিয়েই আজ রাতে ঘুমিয়েছে যে, হয়তো কাল সকালে তাদের সন্তানের ডাকেই ঘুম ভাঙবে তাদের।
.
.
কাল কি আসলেই আমাদের সন্তানেরা একটাবারের জন্য বৃদ্ধাশ্রমে পা দিবে? সৃষ্টিকর্তা কি শুনবে আমাদের আর্তনাদ? হ্যাঁ। আমি জানি সৃষ্টিকর্তা আমাদের আর্তনাদ শুনবেই। কারণ আজ চাঁদরাত। আর চাঁদরাতে সৃষ্টিকর্তা অনেক খুশি থাকেন আর সবার আবদার রাখেন। আমি জানি কাল আমার ছেলে মেয়ে আমার সাথে দেখা করতে এই বৃদ্ধাশ্রমে আসবেই!
.
.
* * * * * সমাপ্ত * * * * *