আজকে ছোটখাটো একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ইন্টার্ভিউ দিতে যেতে হবে। সেই জন্যে সকাল সকাল রেডি হচ্ছিলাম। তখনই মা এসে আবার একই কথা বলতে লাগলো :
— ইভান,,তোকে না বলেছিলাম তোর বাবার হার্টের ঔষধ গুলো এনে দিতে। তোর টিউশনির টাকা থেকে এনে দে। তোর বাবা মাইনে পেলে নিয়ে নিস।
— ধ্যাত সকাল সকাল মেজাজটা খারাপ করো নাতো। টিউশনি থেকে কয় টাকাই আর পাই। কয়েকটা টাকা জমেছে আর সেগুলো ভাঙার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছো। দেখতেই পাচ্ছো একটা শুভ কাজে বেরোচ্ছি।
— বাবা তোর বাবার ঔষধ প্রায় শেষ,, জানিসই তো তোর বাবা ঔষধ ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারে নাহ।
— তুমি যাবে এখান থেকে,, মাইনে পেলে তারপর কিনে নিতে বলো।
অতঃপর রাগে ইন্টার্ভিউয়ের সব কাগজ পত্র নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সকাল সকাল মেজাজটাই পুরো খারাপ করে দিলো। মনে হচ্ছে আমার কাছে টাকার গাছ আছে –যে চাইলেই পাওয়া যায়। অতঃপর সেদিনের মতো ইন্টার্ভিউ দিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। তারা বলেছে ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে রেজাল্ট জানিয়ে দিবে। বাসায় ঢুকেই আব্বুর সামনে পড়ে গেলাম, বুঝতে পারছিলাম এখন প্রশ্ন করে করে আমার মাথাটা খাবে — আমার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই আব্বু বলতে লাগলো :
— বাবা,, তোর ইন্টার্ভিউ কেমন হলো??
— হ্যা, ভালো হয়েছে।
— তো তারা বললো না চাকরিটা হবে কিনা??
— নাহ,, তারা এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দিতে চেয়েছে।
— দেখ বাবা আল্লাহ আল্লাহ করে যেনো চাকরিটা হয়ে যায়। তাহলে আমিও একটু বেঁচে যাই। যে টাকা মাইনে পাই সেটা দিয়ে কি আর সংসার চলে।
— তোমরা কি ভাবছো, আমি চাকরি পেলে ওই টাকা দিয়ে তোমাদের সংসার চালাবো। আমার নিজের কোনো ভবিষ্যৎ নেই নাকি!
— সংসারটা তো তোর ও বাবা,, চাকরি পাওয়ার পর কিছু টাকা যদি সংসারে দিস। তাহলে আমার উপর থেকে কিছুটা চাপ কমে।
— সেটা পরে দেখা যাবে। আমি এখন আসি।
এই বলেই আমি সরাসরি আমার নিজের রুমে চলে এলাম। আব্বুর কথা শুনতে শুনতে প্রায় বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। চাকরি টা পেলামই না তার আগেই টাকার হিসেব শুরু করে দিয়েছে। সবাই যে আমাকে কি ভাবে বুঝতে পারিনা।
পরেরদিন সকালবেলা দেখতে পেলাম আমার চাকরীর রেজাল্ট টা চলে এসেছে। আর সেটাতে আমার চাকরীও হয়ে গিয়েছে। মাইনেটা একটু কম — মাত্র ১৬ হাজার টাকা। কিন্তু তাতে কি চাকরীটা তো পেয়ে গিয়েছি। সামনের মাসে চাকরীতে জয়েন করতে হবে। অতঃপর আর নিজের রুমে দেরি করলাম নাহ। সোজা আম্মু আব্বুকে চাকরীর খবরটা দিলাম। তারা অনেক খুশী হলো। তারপর আব্বুকে বলতে লাগলাম:
— আব্বু আমার দুই হাঁজার টাকা লাগবে,, বন্ধুদের খাওয়াবো।
— এখনও তো মাইনে পাইনি,, কিভাবে দিবো বল বাবা। আর তুই তো জানিস দুই হাঁজার টাকা আমাদের কাছে অনেক কিছু।
— এতকিছু আমি জানিনা,,, এখনই আমার দুই হাঁজার টাকা লাগবে ব্যাস।
— তোর বাবা,, মাইনেটা পেলে নাহয় নিস। (আম্মু)
— নাহহ এখনই লাগবে আমার। তোমাদের কাছে না থাকলে কোথাও থেকে ধার করে এনে দাও।
— আচ্ছা,, বাবা আমি দেখছি ( আব্বু)
সন্ধ্যে হতেই দেখতে পেলাম আম্মু এসে আমার হাতে দুই হাঁজার টাকা ধরিয়ে দিলো। তারপর জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারলাম যে — পাশের বাসা থেকে টাকাগুলো ধার করে এনে দিয়েছে। ধার করেই আনুক আর যেভাবেই আনুক তাতে আমার কি। আমি তো টাকাগুলো পেয়ে গিয়েছি। অতঃপর টাকাগুলো দিয়ে — আমার ফ্রেন্ডসদেরকে নিয়ে ভালো একটা রেস্টুরেন্টে পার্টি দিলাম। দেখতে দেখতে চাকরীতে জয়েন করার সময় চলে এলো। চাকরীতে জয়েন করার দুইদিন আগে এক বন্ধু বুদ্ধি দিলো একটা বাইক কেনার জন্যে। আইডিয়াটা আমারও বেশ মনে ধরলো। অতঃপর সেদিন রাতে আব্বু বাসায় ফেরার পর — আব্বুর কাছে গিয়ে বলতে লাগলাম:
— আব্বু তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে??
— হ্যা বলনা কি কথা।
— দুইদিন পরে তো আমার অফিস জয়েন করতে হবে । তাই ভাবছিলাম যদি একটা বাইক কিনি তাহলে যাতায়াতেও অনেক সুবিধা হতো।
— কি বলিস রে, একটা বাইকের দাম তো অনেক টাকা। বাইক কিনে দেওয়ার মতো সামর্থ্য কি আমার আছে বল??
— আমার শখই যদি পূরণ করতে না পারো তাহলে আমাকে জন্ম দিয়েছিলে কেনো??
— এভাবে বলিস না বাবা।
— আমি এতসব জানিনা,, আমাকে কালকের মধ্যে দুই লাখ টাকা এনে দিতে হবে। নাহয় রইলো তোমার চাকরী, কোনো চাকরীই করবো না আমি ।
— না না,, চাকরী বাদ দিবি কেনো তুই। আমি ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে হলেও কালকে তোকে দুই লাখ টাকা এনে দিবো।
— হুম মনে থাকে যেনো ।
অবশেষে দেখতে দেখতে সেইদিন পেরিয়ে গেলো। পরের দিন আব্বু অফিস থেকে ফিরেই আমার হাতে দুই লাখ টাকার একটা বান্ডিল ধরিয়ে দিলো। আমি স্পষ্ট খেয়াল করছিলাম — আব্বু টাকাগুলো আমার হাতে দেওয়ার সময় আব্বু চোখে পানি টলমল করছিলো। কিন্তু নিজের ছেলের সামনে কাঁদতেও পারছিলো নাহ। অতঃপর আব্বু চলে যাওয়ার আগে শুধু একটা কথাই বলে গেলো — যেদিন আমি থাকবো না সেদিন ঠিকই বুঝতে পারবি। মধ্যবিত্তদের কতো জ্বালা।
(১ বছর পরে)
হ্যা আব্বুর কথা গুলে কাটায় কাটায় মিলে গিয়েছে। আমি অফিস জয়েন করার কিছুদিন পরেই আব্বু চিরকালের মতো চলে যায় -না ফেরার দেশে। তারপর থেকেই পুরো সংসারের ভার আমার উপর এসে পড়ে। এখন ঠিকই হারে হারে টের পাই আমি — সংসার চালানো কতটা কষ্টের। যখন মাথার উপর বাবা নামক ছাঁদটা ছিলো তখন একঝলক রোদও গায়ে লাগতো নাহ। কিন্তু এখন সারাদিন বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিলেও — কেউ দেখার নেই। এখন বুঝতে পারছি একটা মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবাদের অনুদান কতটা। হাঁজার কষ্ট পাওয়ার পরেও তারা — শুধু মাত্র তার পরিবারের দিকে তাকিয়ে সব কষ্টগুলো সহ্য করে যায়।
তাই জীবনটা কোনো সিনেমা নয়, যার টাকা নেই তার কেউ নেই। হ্যা এটাই বাস্তব — মধ্যবিত্তদের স্বপ্ন দেখা পাপ – মহা পাপ।
(THE END)…