আমার ডায়েরির গল্প Love Story

১২.০৩.২০০৭,
আজ কে প্রথম ডায়েরি লিখতে বসলাম। বন্ধবীদের ভাষ্যমতে “নাতি নাতনিদের গল্প শুনানোর জন্যে হলেও কিছু সৃতি লিপিবদ্ধ করে রাখতে হয়। তাই কালকে থেকে যেন ডায়েরি লেখা হয়।”
” কিন্তু ক্লাস টেনে পড়া মেয়ে ডায়েরিতে কি লিখবো”
,
ওদের বলতেই রেগে গেলো চুন্নিরা।
ওদের কথাতেয় আজকে স্কুল থেকে ফেরার সময় একদোকান থেকে ডায়েরি কিনে এনেছি। প্রথম দিন কি লিখবো কিছু বুঝতেই পারছিনা। আমার নামটাই তো লেখা হলো না! আমি ছোয়া শেখ। বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান বড় ভাইয়া সবুজ শেখ। ব্যাংকে চাকরি করে।
এই পর্যন্তই না হয় আজকে থাকুক।
,
,
১৭.০৩.২০০৭,
নিচের তলে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। শুনেছি ভাইয়ার বন্ধু আর তার মা থাকবে।
ওনার বাবা নেয়। ভাইয়া আর উনি একি ব্যাংকে চাকরি করে সে সুত্রেই হয়তো তাদের বন্ধুত্ত্ব। মা ওনার নামটা যেন কি বললো! ও হ্যা, মনে পড়েছে “আকাশ” ওনার নাম আকাশ।
,
মা ডাকছে, ওনাদের ঘর গোছাতে সাহায্য করতে। তাই আজকে আর বেশি কিছু লেখা হলো না।
,
,
১৮.০৩.২০০৭,
ছাদে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আকাশ ভাইয়ের গান শুনছিলাম। উনি অবশ্য আমাকে দ্যাখেনি। ভারী মিস্টি কন্ঠ ওনার।
,
কালকে এসেছে আর আজকেই ওনার সাথে কথা বললে কেমন একটা হয়ে যাবে। নিজের ভাব কমাতে পারবো না। তাই পিছন থেকে গান শুনেই কেটে পড়লাম।
,
২০.০৪.২০০৭,
আজকে স্কুল থেকে ফেরার সময় কিছু বেয়াদব টাইপ পোলা-পাইন আমাকে ডিস্টার্ব করছিলো। প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলো।
আর বলেছিলো ” কালকের ভিতর উত্তর চাই। যদি না দিতে পারো, তোমার এমন হাল করবো যে সমাজে মুখ দেখাতে পারবেনা।”
,
কথাটা শুনে ভয়ে আমি থর থর করে কাপছিলাম।
খুব খারাপ লাগছিলো। মেয়েরা কি শুধু ব্যবহারের বস্তু! রাস্তায় কোনো মেয়েকে দেখলেই কি খারাপ নজরে দেখতে হবে? খুব কান্না পাচ্ছে আমার। আজকে আর ডায়েরী লিখবোনা।
,
,
২৮.০৪.২০০৭,
গত একসপ্তাহ আমি স্কুলে যাইনি। ওই ছেলেগুলোর ভয়ে, না জানি কি করে বসে। ভাইয়া মা অবশ্য জিজ্ঞাসা করেছিলো কিন্তু আমি বলতে পারিনি। খারাপ লাগছে বলে কাটিয়ে দিয়েছি।
,
কিন্তু সন্ধ্যা বেলা ছাদে যখন আমি ফুলের টবে পানি দিচ্ছিলাম তখন আকাশ ভাই ছাদে যায়। আমি আমার মন মত কাজ করছিলাম।
,
-ছেলে গুলো কি বলেছে?
,
আকাশ ভাইয়ের এমন প্রশ্নে আমি একটু অবাক হলাম। এছাড়াও অবাক হওয়ার আরেকটা কারণ হলো, আকাশ ভাইয়েরা আমাদের এখানে ঊঠেছে দশদিন মত হলো। কিন্তু এখন অবধি এটাই ছিলো ওনার সাথে আমার প্রথম কনভারছেশন।
,
– ছেলেগুলো কি বলেছে?
,
আমার চুপ থাকা দেখে আবার জিজ্ঞাসা করলো কিন্তু চোখ মুখের ভাব বদলে গেছে ওনার।
চোখের দিকে তাকিয়ে আবার সরিয়ে নিলাম। ওনার চোখে যেন আগুন জ্বলছে। চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাধ্য আমার নেই, যদি কিনা সেই আগুনে আমি ঝলছে যায়।
,
আবার চোখমুখ শক্ত করে জিজ্ঞাসা করলো,
,
-আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেছি নাকি উত্তর দিবা নাকি এখন ছাদ থেকে ফেলে দিবো।
,
ভয়ে ভয়ে আমি ঢোকগিলে আকাশ ভাইয়ের কথার জবাব দিলাম,
,
-কক কোন ছেলে গুলো?
,
-দেখো ছোয়া আমি সব জানি। আমি অফিসের একটা কাজে তোমাদের স্কুলের পাসের একটা বাসাতে যাচ্ছিলাম। ঐ ছেলেগুলো তোমাকে ডিস্টার্ব করেছিলো আমি দেখেছি। আমি ওদের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সবাই ওখান থেকে হাওয়া হয়ে গেছিলো আর তার আগেই তুমি ওখান থেকে চলে গেছিলে।
,
ওনার রাগ দেখে তোতা পাখির মত সব কিছু করে বলে দিলাম নাহলে যদি উনি আমাকে আবার ছাদ থেকে ফেলে দেয়!
,
আমার কথায় উনি একটাই উত্তর দিয়েছিলো আর সেটা হলো “আচ্ছা”।
এটা বলে উনি ছাদ থেকে নেম যায়।
,
,
৩০-০৪-২০০৭,
আমাকে যারা ডিস্টার্ব করতো তারা সব হাসপাতালে ভর্তি। কাজ টা কে করেছে আকাশ ভাই। এই দুইদিন আমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা করেছে। আমাকে সামনে আগাতে বলে কোনো দরকারে আসেপাশে গিয়েছিলো।
,
কিন্তু ফিরে এসে দেখে আগের দিনের ছেলেগুলো আমাকে ডিস্টার্ব করছে।
আকাশ ভাই কোনো কথা না বলেই নিজের প্যান্টের বেল্ট খুলে আচ্ছা রকম মারতে থাকে ছেলেগুলোকে।
মনে হচ্ছে যে কোনো হিংস্র প্রাণী শিকার ধরে খাচ্ছে।
ওনার এরকম রাগ দেখে আমি(গাধা) ওখানেই জ্ঞান হারাই। যখন চোখ খুলি নিজেকে আমার ঘরের বিছানায় আবিস্কার করি।
,
০২.০৫.২০০৭,
একমাস খুব মজা করেছি আমি। ছেলেগুলো আমাকে আর ডিস্টার্ব করেনা। আকাশ ভাই আমাকে নিয়ে এখানে ওখানে যায়। প্রতিদিন বিকালে ফুচকা খাওয়া ঘুরতে যাওয়া, এসব করেই একমাস পার হয়েগেছে।
,
১৫.০৫.২০০৭,
পাড়ায় একটা ছেলে আজকে দেখলাম আমাকে ভাবি বলে ডাকলো। বয়স অবশ্য আমার থেকে বেশি। তবুও ভাবি বলছে। কিন্তু ভাবার বিষয় হচ্ছে আমি ওনার কোন ভাইয়ের বউ নিজেই জানিনা।
আজব। হাহাহাহা।
,
১৫.০৭.২০০৭,
টানা দুইমাস অসুস্থ ছিলাম হালকা জ্বর, আর বমি স্কুলে যাওয়া হয়না ঠিক মত।
এই দুমাসে দুই একবার জ্ঞান হারিয়েছি। আকাশ ভাইয়ের মাতো সারাদিন আমাদের বাসায় পড়ে থাকে। আমার মায়ের মতই আমাকে যত্ন নেয়।
,
১৭.০৮.২০০৭,
ভালো ডাক্তারের কাছে ওষুধ খেয়েছি এই একমাস। তাই এখন আমি সম্পুর্ন সুস্থ।
,
২৯.০৮.২০০৭,
আজকে আকাশ ভাইয়ের সাথে খুব ঘুরেছি। ঠিক আগের মত। ফুচকা খাওয়া পার্কে যাওয়া এভাবে খুব মজা করেছি।
,
,
১৫.১০.২০০৭,
আন্টি আমাকে আকাশ ভাইয়ের বউ করতে চাই। আকাশ ভাই আমার ভাইয়ার সমবয়সী হওয়ায় মানে আমার থেকে ১০ বছরের বড় হওয়ায় বাবামার একটু অমত ছিল। কিন্তু ভাইয়ার জোরাজোরিতে তারা হার মেনে নিয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর বিয়ে হবে। আন্টি তাতেই রাজি। এসব নিয়ে আমার অথবা আকাশ ভাইয়ের মাথা ব্যাথা নেয়।
,
০১.০১.২০০৮,
আজকে আকাশ ভাই আমাকে নিজের মনের কথা জানিয়েছে। বলেছে যে সে আমাকে ভালোবাসে। ভালোবাসা সম্পর্কে ভালোই জ্ঞান হয়েছে। আর যেহেতু আমার আর আকাশ ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েই আছে তাই তার প্রতি আমার অনুভূতি অনেক। এটা ভালোবাসা কি আমি বুঝিনা, কিন্তু তার সাথের মুহুর্তগুলো খুব ইনজয় করি। সারাটাদিন তার সাথে কাটাতে চাই। এটার নাম কি ভালোবাসা?
যদি এটার নাম ভালোবাসা হয় তাহলে আমি আকাশ ভাইকে ভালোবাসি। তবে তাকে আমি এখন এসব বলবো না।
তাই তাকে জানিয়েছি যে,
-আপনি ভালোবেসে যান। বিয়ের পর আমিও বাসবো।
,
আমার এতোটুকু কথাতেই সে খুশি।
,
০৩.০৪.২০০৮,
,
আগের মত আবার মাথায় ব্যাথা শুরু হয়েছে। তাই তিন মাস ডায়েরিতে হাত দিতে পারিনি। লেখা হইনি কিছুই।
,
২৫.০৫.২০০৮,
,
আজকে আমার টেস্টের রিপোর্ট এসেছে।
সবার মুখে চিন্তার ভাব কিন্তু কেও আমাকে কিছু বলছেনা। জিজ্ঞাসা করলেই বলছে কিছু হয়নি। ছোটো একটা সার্জারি করলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সবার চেহারা অন্য কিছু বলছে। আচ্ছা, আমি মারা যাবো নাতো।
,
২৭.০৭.২০০৮,
আমি এখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। ডায়েরিটা সাথেই এনেছি। আগামি মাসের ৫ তারিখ নাকি আমার ছোট্ট সার্জারিটা করা হবে। কিন্তু আমার মাথা ব্যাথা মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বলছে, এটা অবেক বড় কিছু।
,
০২.০৮.২০০৮,
,
আকাশ ভাই আমার হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে খুব কাদছিলো। ওনার মুখেই শুনতে পারলাম যে আমার ব্রেইন টিউমার হয়েছে, বাচার চান্স দশ শতাংশ।
,
আমি বলেছিলাম,
-আকাশ ভাই তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। আজকে বলতে চাই।
,
-কি কথা ছোয়া বলো?
,
-আমার এই ছোট্ট মনটাই তোমাকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন ছিলো। আমাদের সংসার হবে। খুনশুটিতে দিন কাটবে আমাদের। কিন্তু তার কিছুই হবেনা। আমিতো দুইদিন পর মারা যাবো। তুমি একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিও।
,
-তোমার কিচ্ছু হবেনা ছোয়া। তোমার আমার সংসার হবে আমাদের বাচ্চা হবে। বিকালের ফুচকা খেতে যাবো সবাই মিলে।
,
-জানো আকাশ ভাই। আমার খুব ইচ্ছা ছিলো। তোমার বউ হয়ে মরতে। অপারেশন টেবিলে যদি মারা যাই তোমার বউ হউয়ার স্বপ্ন টা এখানেই শেষ হয়ে যাবে। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি আকাশ ভাই। আমি তোমাকে ছাড়া থাকবো কিভাবে। (কান্না করতে করতে)
,
আমার কথায় উনি কোনো উত্তর না দিয়ে চলে গেলো। হয়তো খুব কান্না করবে। কাদুক নিজেকে একটু হালকা করুক।
,
০৪.০৮.২০০৮,
,
আজকে আমার আর আকাশ ভাইয়ের বিয়ে। সবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই উনি আমালে বিয়ে করছেন। আমার মা অবশ্য আকাশ ভাইকে নিষেধ করেছিল। কিন্তু ওনার কথা আমাকে বিয়ে করবে এই কারণে যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়, কিয়ামতের দিন যেন আল্লাহর কাছে আমাকে চাওয়ার অধিকার থাকে।
,
০৫.০৮.২০০৮,
,
আর একঘন্টা পর আমার সার্জারি শুরু হবে লিখতে খুব কষ্ট হচ্ছে তবুও লিখছি। এখন আর মরেও কষ্ট নেয়। আমি আকাশের স্ত্রী হিসেবেই দুনিয়া ত্যাগ করবো। এটা হবে প্রশান্তির মৃত্যু।
,
,
০৩.০৭.২০১৩,
,
সাত দিন আগে আমি সুস্থ হয়েছি, মানে কোমা থেকে ফিরেছি। সেদিন অপারেশন সাকসেস হয়ে ছিলো কিন্তু অতিরিক্ত ব্লাডক্ষরণ হওয়ায় আমি কোমাতে চলে গেছিলাম। সাতদিন আগে আমি চোখ মেলেছি।
,
চোখ খুলে নিজেকে আকাশের রুমেই আবিষ্কার করি। এই কয় বছর কি হয়েছে আমি কিছুই জানিনা। যেন মনে হচ্ছে গতকাল আমার অপারেশন হয়েছে। কারণ এতোদিন তো আমার কোনো হুশই ছিলো না। এই পাঁচ বছর আমার আকাশের কেমন কেটেছে আল্লাহয় জানে। বাবামা ভাইয়া, আমার শ্বাশুড়ি কত কষ্টই না করেছে আমার জন্য এই কয়েক বছর। ভাইয়ার বিয়ে হয়ে গেছে দুই বছরের একটা মেয়েও আছে। আমার আকাশ কাছথেকে আল্লাহ আমাকে কেড়ে নেয়নি। হাজারো শোকর আল্লাহর কাছে।
,
০৪.০৫.২০২০,
,
নিজের সংসার সামলাতে সামলাতে আর ডায়েরি লেখা হয়ে ওঠে না।আমার জমজ দুই মেয়ে বয়স, ছয় বছর, আমি আকাশ খুব সুখেই আছি। এটাই আমার প্রাপ্তি।
নিজের নাতি-নাতনীদের গল্প শুনানোর মত অনেক কিছুই আমার জীবনে ঘটেছে। আজকেই শেষ ডায়েরি লিখছি। আর লেখার দরকার হবে না। কারন আল্লাহর করুণায় আমি পূর্ণ হয়েছি। যায় আকাশ আবার আমাকে ডাকছে।

লেখিকা – রাফিজা আখতার সাথী

……………………………

আপনার লেখা সরাসরি আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিতে পারেন  আমাদের এডমিনগণ আপনার লেখা যাচাই বাঁচাই করে আমাদের ব্লগে মূল পাতাই আপনার লেখাটি প্রকাশ করবেন ।

হেড এডমিন এর fb.com/YousufRanaDhali