তৃতীয়া ১ম পর্ব

নিজের বাবা-মা যখন আমাকে এতিমখানায় রেখে যায় তখন আমি একটুও অবাক হয়নি। আমার মত মানুষের এতিমখানায় ঠাই পাওয়া টাও ভাগ্যের বিষয়।

না আমি কোনো বেয়াদবি করেছি আর নাইবা কাওকে ডিস্টার্ব করেছি তবুও আমি যার গর্ভে জন্ম নিয়েছি সে আমাকে বোঝা মনে করে। ,আমার নাম শাওন। মা বাবার ৩য় সন্তান। সবার বড় আমার ভাইয়া রিয়াদ আর মেজো হলো আমার আপু মাহি। আমাকে ছোটো থেকেই কেও সহ্য করতে পারতো না।

না বাড়ির মানুষ না পাড়ার লোকজন। যেখানেই যেতাম তারা হাততালি দিতো আর কি যেন বলতো, সেসব কথার মানে আমি বুঝতাম না সেসময়। আসলে সেসব ভালো ভাবে বুঝে ওঠার বয়স হওয়ার আগেই মাত্র ৬ বছর বয়সে আমার স্থায়ী ঠিকানা হয় এতিমখানা। ,এতীমখানায় রেখে যাওয়ার পর বাবা-মা তিন চার মাস পরপর দেখা করতে আসতো। এভাবে চার বছর চলে যায়। আস্তে আস্তে এতিমখানাও আমার কাছে তিক্ত হয়ে ওঠে।

কারণ সব জায়গার মত সেখানেও কেও আমাকে ভালোচোখে দেখতনা। আমিও মানুষ ছিলাম তবে কেন এতোটা পার্থক্য করা হতো অন্যদের আর আমার মধ্যে কিছুই বুঝতাম না।,একদিন চক দিয়ে স্লেটের উপর বাবা-মা আর ভাইয়া আপুর ছবি আঁকছিলাম। অবশ্য এই ছবি দেখলে বোঝাই যাবেনা যে কোনটা কে। শুধুমাত্র অনুধাবন করা যাবে বড় দুইটা মা-বাবা আর ছোটো দুইজন তাদের ছেলে-মেয়ে। আমার ছবিটা আকার প্রয়োজন মনে করিনি। ,হঠাৎ এতীমখানার রাধুনি কাকী হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে বলল,,

– শাওন তোর জন্য জব্বর একটা কাজ পেয়েছি। করবি নাকি? ,তখনও আমার ছবির চতুর্থ ব্যক্তি অর্থাৎ আমার বোনের হাত পা আকা বাকি ছিলো। আমি স্লেট থেকে মাথা উচিয়ে ওনার দিকে তাকালাম। ওনার চোখগুলো চকচক করছে। মনে হচ্ছে লোভনীয় কিছু আছে আমার কাছে। আমি আমার আশেপাশে তাকালাম কিন্তু মানুষের লোভ পাবে এমন কিছু খুঁজে পেলাম না। তাই আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,,

-কাকি আমার জন্য কিসের কাজ পেয়েছেন? আমার তো কেবল ১০ বছর বয়স এখন আমার কাজের কি কোনো দরকার আছে?,

– আছে বৈকি! তোর জন্য এতিমখানার সমস্ত ছেলে মেয়েরা খুবই বিরক্ত হয়। ,-কিন্তু আমি তো তাদের সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার বা ঝগড়া-মারামারি কিছুই তো করিনা।,-তুই নিজেই যে পাপ!,কথাটা শুনে চোখ দিয়ে গড়গড় করে পানি ঝরতে লাগল। কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, ,-কাকি আমি তো মানুষ আর মানুষ হয়ে জন্মানো কি পাপ?, তখন উনি একটু মুখ ভ্যাংচিয়ে বললো, ,-তোর মুখে কাকি ডাকটা শুনতে আমার বড্ড বিরক্ত লাগে রে। আর হ্যাঁ মানুষ হয়ে জন্মানো পাপনা তোর মত মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়া পাপ। ,- আমার ভিতর কি আছে যার জন্য আমি পাপ? ,- শোন এসব কথা বলার সময় নেই। এখন বল কাজ করবি কিনা। তিন বেলা ভালো খেতে পারবি।,

আগের কথাগুলো ভালো না লাগলেও এই কথাটা মনে গেথে গেছে। কারণ এতীমখানায় খাবার ঠিক মত দিলেও সেটা ভাগ্যে খুব একটা জোটে না। কেওনা কেও তার ভিতর ভাগ বসায়। আমি কিছু বলতে গেলেই সবাই মিলে আমাকে দোষী বানিয়ে সুপারের কাছে নিয়ে যায়। উনি আমার একার কথা বিশ্বাস করেন না। এই ঘটনা নিত্যদিনই হয়। খেয়ে না খেয়ে জীবন পার করি আমি। ,,রাধুনি কাকি আমার হাত ঝাকিয়ে বলল,,- কিরে কোথায় হারিয়ে গেলি?,আমি আর কোনো কথা না ভেবেই বলে দিলাম,,- হ্যা আমি কাজ করতে চাই।,- ঠিক আছে রাতে তুই তৈরী থাকিস। ওরা নিতে আসবে।,

এই বলে কাকি চলে যায়।,আমিও ঠিকঠাক খাওয়ার লোভে নিজের যে কয়টা কাপড় আছে সব গুছাতে থাকি। ,রাতে রাধুনি কাকি আমাকে গোপনে এতীমখানা থেকে বাইরে যেতে সাহায্য করে। দুইজন মহিলা বাইরে দাড়িয়ে ছিলো। আমি যেতেই একজন আমাকে নিয়ে রিকশায় উঠে যায় আর অন্যজন নিজের পার্সথেকে কিছু একটা বের করে রাধুনি কাকিকে দেয়। চাদের আলো থাকায় বুঝতে পারলাম কিছু টাকা দিচ্ছে। তারমানে এই মহিলা আমাকে বিক্রি করে দিলো!,এরপর অন্যজনও রিকশায় উঠে যায়। আমাকে দাড় করানো আর কোলে বসানোর মাঝামাঝি অবস্থানে রেখে তারা। কারণ রিকশায় ৩ জন পাশাপাশি বসা সম্ভব না। এরপর কিছু মনে নেই। , ঘুম ভাঙতেই একটা ঘরে আবিষ্কার করলাম। সকালও হয়ে গেছে। কাল রাতের একজন মহিলা আমাকে ডাক দিলেন।,- এই মেয়ে উঠে বস তাড়াতাড়ি। কাজে যেতে হবে।,মহিলাটির কথা কিছুটা পুরুষ টাইপের। আমি বললাম,,- কোথায় কাজে যাবো? আর আপনি এমন ছেলেদের মত কথা কেন বলছেন।,উনি তখন হোহো করে হাসতে লাগলো।

মিনিট খানিক হাসার পর একটু শান্ত হলো, তারপর বলল,,- আর ৪/৫ বছর পর দেখবি তুইও এমন কথা বলছিস।,- না আমি ছেলে আমি কথা বলবো না। ,- হাহা। সে দেখা যাবে, এখন চল কাজে যায়।,এভাবেই দিন চলে যায়, মাস চলে যায়, অনেক বছরও পার হয়ে যায়। নিজের মা-বাবা চেহারা ভুলতে বসেছি একেবারেই।

যাদের কাছে আছি এরাই এখন সব মনে হয়। যেই মহিলা দুটো আমাকে এখানে এনেছিলো তারা গত হয়েছেন ২ বছর আগে, একটা রোড এক্সিডেন্টে। ,আজকে এই এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এখানকার লোকজন কাজের টাকা কম দেয়। তাই অন্যকোথাও যাবো। আমার একজন সই একটা গ্রামের নাম বলল। মাইল শ দুরে হবে। আজকে থেকে সেখানেই থাকবো। ,,নতুন গ্রামে পা রাখতেই কেমন একটা শীতল অনুভূতি হলো।

যেন এই মাটি আমার খুব চেনা। আমাকে আরো আকড়ে ধরে রাখতে চায় এই মাটি।