এরই নাম ভালোবাসা

-রাফিজ তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো কেন?

আমি যে তোমার ভালোবাসার এক অংশও তোমাকে দিতে পারিনা।,রাফিজ ভাত মাখিয়ে রিয়ার মুখে দিয়ে বলল,,- এই আমাকে সারাক্ষণ আমার সাথে থাকতে চাও, আমার হাতে মাখা ভাত খেতে চাও এরই নাম ভালোবাসা।,রিয়া চোখের পানি ফেলে বলল,,- তবুও রাফিজ, আমি অন্য স্ত্রীর মত তোমার জন্য সকালে চা করে দিতে পারিনা, নিজ হাতে তোমার টাই লাগিয়ে দিতে পারিনা। ,

– এগুলার নাম ভালোবাসা না রিয়া। এই যে আমি চেম্বারে যাওয়ার আগে তোমার কাছে নিজের কপাল নিয়ে আসি আর তুমি তোমার ঠোঁট দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে দেও এটাই তো ভালোবাসা। এর চেয়ে আর বেশি কিছু কি দরকার আছে!,রিয়া আর কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে নিতে লাগলো। সে জানে যত কথায় বলা হোক না কেন রাফিজকে হারানো সম্ভব না। তাই আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শেষ করলো।,এক্সিডেন্টের পর থেকে রাফিজ ডাক্তারি করাটাও ছেড়ে দিয়েছে। সারাক্ষণ যেন রিয়াকে দেখে রাখতে পারে সে জন্য বাসার নিচেই ব্যাক্তিগত চেম্বার খুলেছে।

এভাবে ভালোবাসায় ভরা সংসারটা চলছে টোনাটুনির। ,একদিন রোগী দেখছিলো তখন বাসার কাজে মহিলা তড়িঘড়ি করে রাফিজের চেম্বারে ঢুকে পড়ে।,রাফিজ একটু অবাক হয় কারণ বাসার কেও চেম্বারে আসে না কোনো সময়। রাফিজ জিজ্ঞাসা করে,,- মরিয়ম খালা কি হয়েছে? এতো চিন্তিত কেন?,- রাফিজ বাবা তাড়াতাড়ি উপরে চলো।,- হাতের রোগীটা দেখে আসছে তুমি যাও।,- না বাবা এখনি যাওয়া লাগবে। খুব জরুরী। ,- রিয়ার কিছু হয়েছে নাকি খালা?,- হ্যা বাবা।,রাফিজ হাতের রোগীটাকে বলল, আপনি একটু বসুন আমি আসছি।,এরপর দ্রুত উপরে যায়। গিয়ে দেখে রিয়া ছাদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাফিজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রিয়ার কাছে এগিয়ে গেলো। কত কিছুই না সে ভেবেছিলো। ,

রিয়ার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,,- রিয়া! কি হয়েছে? মরিয়ম খালা খুব চিন্তিত দেখলাম!,রিয়া রাফিজের কথা শুনে লজ্জায় অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। রাফিজের আর বুঝতে বাকি নেই যে ঘরে নতুন অতিথি আসার সময় বুঝি হয়ে এসেছে। রাফিজ রিয়ার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,,,- রিয়া! সত্যি?,রিয়া নিজের মাথাটা উপর নিচ করে জানান দিলো যে হ্যা।,রাফিজ এখনো প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিয়ার দিকে। রিয়া বুঝতে পারলো রাফিজ বিশ্বাস করছে না তাই বলল,,- আমিও একজন ডাক্তার ভুলে যেওনা। নিজের অবস্থা নিজে বুঝবোনা তাই কি হয়!,ব্যাস! রাফিজের খুশি আর আটকায় কে! রিয়াকে কোলে তুলে সারা ঘর নেচে বেড়াতে লাগলো। রিয়া বলল,,

– এই, বাবুর লাগবেতো!,রাফিজ রিয়াকে আস্তে আস্তে বিছানায় শুইয়ে দিলো। পেটে আলতো করে চুমু দিয়ে বলল,,- এটা আমার জীবনের ২য় সেরা গিফট রিয়া। আমার খুশি আমি দেখানোর ভাষা পাচ্ছিনা।,- প্রথম সেরা গিফট কি?,রাফিজ মুচকি হেসে রিয়ার পাশে শুয়ে পড়লো। হাতটা রিয়ার পেটের উপর রেখে বলল,,- যার পেটে আমার সন্তান রয়েছে সে আমার জন্য প্রথম এবং সেরা গিফট আল্লাহর তরফ থেকে।,রাফিজের কথা শুনে রিয়ার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। রাফিজ চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল,,- খুশির দিনেও তোমার কাদা লাগবে?

এতো কান্না পাও কোথা থেকে তুমি?,- আমি কান্না আঁটকে রাখতে পারিনা রাফিজ। সেদিন যদি…….,- তোমাকে নিয়ে আমি কখনো বিরক্তি দেখিয়েছি, কখনো চিন্তা করেছি?,- না।,- তাহলে তুমি কেন কষ্ট পাবে বারবার? তুমি আমার জীবনে আছো এটাই তো বড় উপহার আমার জন্য আর কিছুই চাইনা আমি। আর একবার কাদলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম।,- আচ্ছা আর কাদবোনা। তুমি চোখের পানি মুছিয়ে দাও।,রাফিজ রিয়ার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে দুই চোখে চুমু খায়।,- দিয়া আমি বাকি রোগীগুলো দেখে আসি। আর আগামী ১০ মাস চেম্বার খুলবোনা জানিয়ে দেবো খুব জটিল রোগ ছাড়া।,- না চেম্বার কেন বন্ধ করবে তুমি? মরিয়ম খালা তো আছেই আর তুমিও যে খুব দূরে থাকো এমন তো না! তাই নো চেম্বার বন্ধ করা ওকে?,

– ঠিক আছে মহারানী। তবে দিনে মাত্র একবেলা। বাকি সারাদিন তোমার সাথে কাটাবো।,রিয়া রাজি হয়ে যায় তার পাগল স্বামীর কথায়। রাফিজ ঘর থেকে বের হয়ে যায়। খাটে হেলান দিয়ে প্রিয়তমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে রিয়া। এই মানুষকে ছাড়া বেচে থাকা বড্ড কষ্টের। এতো ভালোমানুষ আজও আছে দুনিয়ায়। এই বন্ধন আর শক্ত করার মানুষ চলে এসেছে। খুশির অশ্রুপাত কি আটকানো যায় এই মুহুর্তে! ,,দেখতে দেখতে পার ডেলিভারির সময় এসেগেছে। গতমাসে আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করে জানতে পেরেছে মেয়ে হবে। ,রিয়াকে নরমাল ডেলিভারি করানো যাবেনা। সেজন্য ডক্টর খানের পরামর্শ লাগবে। রাফিজ ডক্টর খানকে কল দিতেই সাথে সাথে রিসিভ করে,,- রাফিজ কেমন আছো? ,- স্যার আমি ভালো আছি। ,এরপর সব কথা ডক্টর খানকে খুলে বলে। কিন্তু ডক্টর খান বলে,,- তুমি নিজেই তো পারো রাফিজ! একজন সিভিল সার্জন হয়েও তুমি কি ভয় পাচ্ছো?,-আমি নিজের স্ত্রীর অপারেশন করতে পারবোনা স্যার। আপনাকেই করা লাগবে।,

-কিন্তু রাফিজ আমিতো ইউকে আছি। আমি তোমাকে ডাক্তার মাহিরের নাম্বার দিচ্ছি আর ওকে বলেও দিচ্ছি।,- এই নামটা তো আগে শুনিনি স্যার!,- তুমি লিভ করার একমাস পর জয়েন করেছে সে। খুব ভালো ছেলে। সবাই তাকে ২য় রাফিজ নামেই ডাকে। ,- ঠিক আছে স্যার নাম্বার দিন।,এরপর রাফিজ নাম্বার নিয়ে ডক্টর মাহিরের সাথে কথা বলে ডেট ফাইনাল করে নেয়।,দুইদিন পর হাসপাতালে নিয়ে যায় রিয়াকে।,অপারেশন সাকসেস হয়ে যায়। সাদা রোমালে মোড়া বাচ্চাকে রাফিজের কোলে দেওয়া হয়। এই প্রথম বাবা হওয়ার অনুভূতি রাফিজের। চোখের পানি কি আটকানো যায়!,রিয়ার কপালে আলতো চুমু একে বাচ্চাকে সেখানে রেখে মাহিরের কেবিনে যায় রাফিজ।,ডক্টর মাহির- আমি ভাবতেই পারছিনা স্যার। আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আমি অপারেশন করেছি।,রাফিজ মুচকি হাসি দিয়ে বলে,,- মন বল সব থেকে বড় জিনিস মাহির। যেটা তোমার আছে। তুমি আমার থেকে সুনাম অর্জন করবে ইনশাআল্লাহ। ,- স্যার আপনার ছোটো ভাই হিসেবে আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাই।,- সিওর!,- আপনার স্ত্রীর এই অবস্থা কিভাবে হলো?,- ” আমরা একসাথে ডাক্তারি পড়া শেষে বের হয়ে বিয়ে করি। খুব সাদামাটা ভাবেই বিয়েটা করি। এরপর দুইজন দুই হাসপাতালে চাকরি জয়েন করি।

দুই বছর পর রিয়া কক্সবাজার যাবে বায়না করে। ছুটি নিয়ে দুইজন কক্সবাজারে যায়। কিন্তু সেটাই ছিলো আমার জীবনের সব চেয়ে খারাপ সময়। ফেরার আগের দিন শপিং করতে গেছিলাম। আমি আর রিয়া দুইজন মিলে শপিং করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম পাশে রিয়া নেই। ভিতরে কোথাও খুজে পেলাম না। দৌড়ে বাইরে বের হয়ে দেখি রিয়া নিথর হয়ে রাস্তার মাঝেখানে শুয়ে আছে।

দুইহাত আর দুইপা যেন মনে হচ্ছিলো কোনো কিছুই পিশে দিয়ে গেছে। আমি দিক শূন্য হয়ে পড়ি। ওই অবস্থায় ওকে কোলে নিয়ে হাসপাতালে চলে যাই। ডাক্তার তুই হাতের কনুই থেকে বাকি অংশ কেটে ফেলে দেয় আর দুই পায়ের হাটুর নিচের অংশ কেটে ফেলে দেয়। এই ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিলোনা। পরে জানতে পারি একটা বাচ্চা মাঝ রাস্তায় চলে গেছিলো। ভিতর থেকে রিয়া সেটা দেখতে পেয়ে বাচ্চাটকে বাচাতে যায়। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে রাস্তার অপর পাশে তার মায়ের কাছে দিয়ে আসার সময় রাস্তার মাঝখানে ছোট্ট ভাঙায় পা পড়ে। আর নিচে পড়ে যায়। আর দুইহাত এবং দুই পায়ের উপর দিয়ে দুইটা গাড়ি দুইদিকে চলে যায়। আল্লাহর রহমতে সে যাত্রায় আমার প্রিয় বেচে যায়।

,- কত বছর আগের ঘটনা এটা?,- পাচ বছর আগের ঘটনা।,- এতো ভালোবাসেন আপনার স্ত্রীকে?,- এরই নাম ভালোবাসা মাহির। প্রিয় মানুষটার গুনগুলো ভালো বাসতে পারলে তার ত্রুটিগুলোকেও ভালোবাসা যায়। ,- থ্যাংকস স্যার। অনেক কিছুই শিখলাম আপনার কাছে। আমি ১ ঘন্টা পর আসছি।,এরপর মাহির হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যায়।,১০ মিনিট পর একটা বাসার সামনে যায়।

কলিং বেল বাজাতেই ৫৫ বছর বয়সী একটা মহিলা দরজা খুলে দেয়। মাহিরকে দেখে ভিষণ অবাক হয়ে যায়। মাহির সালাম দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। সোফাতে বসে আছে জনাব খালেকুজ্জামান সাহেব। মাহির তার সামনে গিয়ে সালাম দিয়ে বলে,,- আংকেল আপনি এখুনি কাজী ডাকুন।,- তোমার কথার মানে বুঝিনি মাহির।,- আমি সামিহাকে বিয়ে করে নিয়ে যেতে এসেছি। আর দেরি করবেন না প্লিজ। সামিহা কোথায় আছে আংকেল।,- ওর ঘরেই আছে যাও।,মাহির সামিহার ঘরের সামনে গিয়ে দেখলো সে চেয়ারে বসে কিছু একটার উপর হাত বুলাচ্ছে। মাহির ধীর পায়ে সামিহার পিছনে গিয়ে দাড়ালো। দেখলো সামিহা তার ছবির উপর হাত বুলাচ্ছে।,সামিহা কারো উপস্থিতি অনুভব করতে পারছে।,

– মাহির! ,মাহির বলল,,- হ্যা সামিহা, আমি তোমাকে নিতে এসেছি। নিজের স্ত্রী করে। ,- হঠাৎ করে এই অন্ধমেয়েটার প্রতি করুণা জন্মালো কিভাবে? আমি এক্সিডেন্টে চোখ হারাইনি মাহির হারিয়েছি তোমাকেও। ,- হারাওনি সামিহা, তাইতো নিতে এসেছি আজকে। সেদিন বিয়ে ভেঙেছিলাম। আজকে নিয়ে করে নিয়ে যাবো। ভালোবাসার চোখ খুলেছে সামিহা। আজকে তোমাকে ভালোবাসবো, আমার সবটা দিয়ে ভালোবাসবো। ,সামিহা হাত বাড়ি দেয়। মাহির বুঝতে পারে সামিহা বুঝতে পারছেনা সে কোন দিকে দাঁড়িয়ে আছে। মামিহাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেই মাহির। সামিহা মাহিরের বুকের মধ্যে ঢুকে চিৎকার করে কাদতে থাকে।,মাহিরও কাদতে থাকে। এরই নাম ভালোবাসা। কিছুক্ষণ পর দুজন চিরকালের বন্ধনে বেধে যাবে,সুখে থাকবে।

এরই নাম ভালোবাসা।,

সমাপ্ত

– রাফিজা আখতার সাথী